সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের ভয়ে রুশ তরুণেরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। রাশিয়ার জনমতের প্রতিফলন ঘটে এ রকম কিছু নির্ভরযোগ্য জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নিয়ে সার্বিকভাবে পুতিনের সমর্থন আগের মতো থাকলেও তরুণেরা বয়স্কদের তুলনায় তাতে সমর্থন কমিয়েছেন।
গত ১০ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী,স্কুল শিক্ষার্থীদের অস্ত্র ব্যবহারের কলাকৌশল প্রশিক্ষণ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া। সাবেক সোভিয়েত আমলে স্কুলে স্কুলে এমন প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পুরনো আমলের সেই প্রশিক্ষণ আবার চালু করার ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে এই সিদ্ধান্ত কতটা সত্য বা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে আপনাকে চমকে উঠতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুতিন সরকার দেশটির কিশোর-তরুণদের মতাদর্শিকভাবে নির্মাণের জন্য বেশ কিছু কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন থেকে ভিন্নমতাবলম্বীদের মতামত সরিয়ে দেওয়া এবং বিদ্যালয়গুলোতে প্রোপাগান্ডামূলক শিক্ষা দেওয়ার মতো বিষয় রয়েছে। তবে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হচ্ছে, কিশোর-তরুণদের নিয়ে অসংখ্য গ্রুপ তৈরি করা। রাশিয়ার শিশুদের সামনে চোখধাঁধানো নানা তথ্য, ছবি, ভিডিও পরিবেশন করা হচ্ছে।
এ ধরনের সবচেয়ে বড় গ্রুপ হলো ইয়ুথ আর্মি। ২০১৬ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুইর অধীনে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি সংস্থায় অথবা সামরিক বাহিনীর উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্যই এই সংস্থার যাত্রা শুরু।
ইয়ুথ আর্মি ও পুতিনের যুদ্ধভাবনা
ইয়ুথ আর্মিকে সামনে থেকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের কেউ পেশাদার রাজনীতিবিদ কিংবা সৈনিক নন। ২৫ বছর বয়সী জনপ্রিয় জিমন্যাস্টিক অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিকিতা নাগোর্নি এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ক্যারিশম্যাটিক ও সুদর্শন নাগোর্নি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তুমুল জনপ্রিয়। এটিকে কাজে লাগিয়ে নানা ভিডিও ও পোস্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা প্রচার করে চলেছেন তিনি।
ইয়ুথ আর্মির মতো প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করছে রাশিয়া। গত বছর কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ইয়ুথ আর্মির জন্য ১৮৫ মিলিয়ন রুবল ভর্তুকি দেওয়া হয়। পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে সংস্থাটি দ্রুত বাড়ছে। প্রায় ১০ লাখ শিশু এখন ইয়ুথ আর্মির সদস্য। ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যালয়পড়ুয়া ২০ শতাংশ শিশুকে এর সদস্য করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইয়ুথ আর্মির ওয়েবসাইট ইউনিফর্ম পরা কার্টুন চরিত্র, যুদ্ধের আদলে তৈরি করা ভিডিও গেমের ক্লিপ, হাসি হাসি মুখের সৈনিকদের ছবিতে সয়লাব হয়ে আছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রুপটির নিউজফিড ও অ্যাপ ব্যবহার করে শিশুরা ভিডিও গেমস খেলতে পারে। যুদ্ধ স্মরণে নির্মিত স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সেটা পোস্ট করতে পারে। দেশপ্রেমমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে তাতে পুরস্কার জোটে। এই গ্রুপের অনেক নতুন সদস্য নিকিতা নাগোর্নির হুবহু অনুকরণ করেন। ইয়ুথ আর্মিতে তাদের কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (বিশেষ করে টিকটক) শেয়ার করেন। সরকারিভাবে রাশিয়ায় টিকটক নিষিদ্ধ হলেও দেশটির কিশোর-তরুণদের মধ্যে এটি দারুণ জনপ্রিয়।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ইয়ুথ আর্মির সদস্যসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এরপর যদি সরকারের তরফ থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তাহলে রাশিয়ার তরুণেরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের তালিকাভুক্তির জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াবেন।
এই গ্রীষ্মে ইয়ুথ আর্মির বেশ কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নেয় গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রত্যেকেই তাদের মতের ক্ষেত্রে ছিলেন স্পষ্ট। তারা কেউ মনে করেন না, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের চাপিয়ে দেওয়ার চিন্তা থেকে তারা ইয়ুথ আর্মির সদস্য হয়েছেন। তারা মনে করেন, ইয়ুথ আর্মি দেশপ্রেমমূলক কাজ করে এবং সেটা দেখে নিজ থেকেই তারা এতে যোগ দিয়েছেন। সংস্থাটির আঞ্চলিক একজন নেতা জানিয়েছেন, ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সংস্থাটিতে সদস্য হতে এত আবেদন জমা পড়ছে যে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কিন্তু ইয়ুথ আর্মি সাধারণ কোনো সংস্থা নয়।
শহীদ হতে চায় এই শিশুরা
দেশপ্রেমভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও ফাঁকা কোনো আওয়াজ নয়। ইয়ুথ আর্মির সদস্যরা বলছেন, ‘মাতৃভূমির জন্য তারা শহীদ হতে চান’। শ্রেণিকক্ষ ও গ্রীষ্মকালীন প্রশিক্ষণ শিবিরে তাঁদের সামরিক কৌশল শেখানো হচ্ছে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম তাদের সেনা সামর্থ্য নিয়ে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে যে গল্প বলছে, তার মূলে রয়েছে ইয়ুথ আর্মি। তারা এমনটাও বলছে, ‘ইয়ুথ আর্মির ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর একমাত্র কারণ হলো, পশ্চিমারা রাশিয়ার শিশুদের ভয় পায়।’
রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিশুদের মধ্যে মতাদর্শিক প্রচারণা এত নিবিড়ভাবে হচ্ছে যে ছয় বছর বয়সী শিশুও এখন যুদ্ধের ভাষায় কথা বলছে। সবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ইয়ুথ আর্মির এক শিশু সে কারণেই স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে গভীর আত্মবিশ্বাসে বলতে পারছে, ‘আমি আমার দেশকে রক্ষা করতে চাই, আমার ভালোবাসা এ দেশটাকে ঘিরেই।’
বেশি বয়সী শিশুরা সত্যি সত্যি এ ধরনের বাস্তবতার মধ্যে বাস করছে। তাদের জন্য সে ধরনের কর্মসূচি রয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণকারী তরুণ সৈন্যদের ‘বীরের’ মর্যাদা তাঁরা দিচ্ছেন। নাগোর্নি তাঁর ভিডিও ও পোস্টে সৈন্যদের জীবনকে অনন্য আদর্শ হিসেবে তুলে ধরছেন। এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শিশুদের ‘সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া, সামরিক কলাকৌশল শেখা ও মাতৃভূমিকে রক্ষা করার’ মতো বিষয় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
ইয়ুথ আর্মি প্রকল্পটি কিশোর-তরুণদের রাজনীতিকরণে রাশিয়া সরকার বড় যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তারই অংশ। প্রচুর অর্থ ঢেলে, ইন্টারনেট সেলিব্রিটিদের দিয়ে তরুণদের জন্য জমকালো অনুষ্ঠান করে জাতীয় স্বার্থসিদ্ধির পথ বেছে নিয়েছে পুতিন সরকার।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ইয়ুথ আর্মির সদস্যসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এরপর যদি সরকারের তরফ থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তাহলে রাশিয়ার তরুণেরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের তালিকাভুক্তির জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াবেন।
এসডব্লিউএসএস১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ