দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, সাম্য, মানবাধিকার এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। বিশেষ করে যুদ্ধ, সংঘাত ও হানাহানি বন্ধ করে বিপর্যস্ত মানবতাকে উদ্ধার করে অন্যের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখার তাগিদ থেকেই এই মহৎ অভিপ্রায়ের শুভযাত্রা ঘটেছিল। ৭৭ বছর আয়ু অতিক্রম করে জাতিসংঘ এখন আস্থার সংকটে পড়েছে। পৃথিবীজুড়েই প্রশ্ন উঠেছে জাতিসংঘ নামক প্রতিষ্ঠানটি আর থাকবে কি থাকবে না। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণেই এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও সংস্থাটি বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা এবং কর্তৃত্ব হারিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এর সর্বশেষ উদাহরণ।
১৯৩৯ সালে ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল আগেরটির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৮ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেলা আনবিক বোমার আগুনে পুড়ে দুই লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। আহত ও পঙ্গু হয় আরো কয়েক লাখ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসলীলা দেখে বিশ্ববাসী সংকিত ও হতবাক হয়। এ অবস্থায় যুদ্ধ চলাকালেই ১৯৪১ সালে বিশ্ব নেতাদের কেউ কেউ একটি নতুন ও অধিকতর শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, যা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সঙ্গে অন্য দেশের নেতাদের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ফলে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৮ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা, সেমিনার, পোস্টার, লিফলেট, আলোচনা, বিতর্ক, পুস্তক প্রদর্শন, চলচ্চিত্র-প্রদর্শন, সংগীত, শিল্প মেলা, খাদ্য মেলা ইত্যাদির মাধ্যমে ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
৫১টি দেশ নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশই এর সদস্য। তবে আগের বহু সংকটের ধারাবাহিকতায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকানো কিংবা সংকটের সমাধানে সংস্থাটি দর্শনীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল। একইভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অনেক সহিংস সংঘর্ষের ঘটনায়ও জাতিসংঘকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং মানবিক সংকটে সময়মতো হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারিতেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি। কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে।
জাতিসংঘকে আরও বিশ্বাসযোগ্য সংস্থায় পরিণত করতে হলে এর সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন ভেঙে পড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের সুদীর্ঘ সংকট নিরসনে জাতিসংঘের নীরবতা শুধু উদ্বেগজনক নয়, রহস্যজনকও। অসহায় ফিলিস্তিন জাতির ভূমি ইসরায়েল দখল করে নিজেরা ভূমিপুত্র সেজে বসে আছে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে। পরাক্রমশালী ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন ও মদদ দিচ্ছে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলি বোমার আঘাতে রক্তাক্ত মরদেহ রাস্তায় পড়ে থাকলে বিশ্ববিবেক শঙ্কিত হয়েছে, আতঙ্কিত হয়েছে । শুধু বিচলিত হয়নি জাতিসংঘ।
মিয়ানমার কর্তৃক অমানবিক ও নৃশংস নির্যাতনে যখন রোহিঙ্গারা দিশেহারা, বাস্তুহারা তখনো জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর কোনো কার্যকরি হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। বাংলাদেশ যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে লক্ষ লক্ষ ভাসমান রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার বড় নজির স্থাপন করলো তখন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজবাসভূমে ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘ কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি
এ রকম শত সমালোচনার মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে জাতিসংঘ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে অবশ্য জাতিসংঘকে ‘আশার ফসল’ বলে অভিহিত করেছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
তিনি বলেন, আজ আমাদের এ প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব এক পরীক্ষার মুখে। তবে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যই।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এখন বিশ্বের প্রতিটা কোনায় জাতিসংঘ সনদের মূল্যবোধ ও নীতি বাস্তবায়ন আমাদের জন্য আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় জরুরি।
জীবন, ভবিষ্যৎ ও বৈশ্বিক অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলা সংঘাতের সমাপ্তি ঘটানো এবং শান্তিকে একটি সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে এ মূল্যবোধ ও নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
চরম দারিদ্র্য বিমোচন, অসমতা হ্রাস এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এ মূল্যবোধ ও নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি আমাদের আসক্তি ভেঙে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপ্লব ঘটিয়ে আমাদের গ্রহটাকে সুরক্ষিত করার মাধ্যমে এ মূল্যবোধ ও নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সুযোগ্য ভারসাম্য সৃষ্টি করে, নারী ও কিশোরীর মুক্তি এবং সবার মানবাধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে এ মূল্যবোধ ও নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, জাতিসংঘকে আরও বিশ্বাসযোগ্য সংস্থায় পরিণত করতে হলে এর সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন ভেঙে পড়বে। জাতিসংঘের পতন হলে দুর্বল দেশগুলোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী দেশগুলোর আগ্রাসনের আরও বহু ঘটনা ঘটবে এবং বিশ্বকে তা আরও বেশি অস্থির, সহিংস এবং বিশৃঙ্খল করে তুলবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতিসংঘের গণতন্ত্রীকরণের জন্য অবশ্যই স্থায়ী সদস্যদের বিশেষ ক্ষমতাকে বিলুপ্ত করতে হবে। জাতিসংঘের সংস্কার অবশ্যই এই ভিত্তিতে হতে হবে যে, প্রতিটি দেশের সমান ক্ষমতা থাকবে এবং প্রতিটি দেশের ভোট সমান মর্যাদা পাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ