ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মিত্র হিসেবে সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা ছিল দেশটি তেলের উৎপাদন বাড়াবে। কিন্তু সৌদি আরব করেছে এর বিপরীত। দেশটি সহ ওপেক প্লাসভুক্ত ও রাশিয়া এরই মধ্যে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে বিশ্ব বাজারে বেড়ে গেছে তেলের দাম।
সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তের কারণে এরপর থেকেই আমেরিকার আইন প্রণেতারা দেশটির সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সৌদি আরব রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করছে।
এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনঃমূল্যায়ন করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) এই তথ্য সামনে এনেছে হোয়াইট হাউস।
বুধবার (১২ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, প্রায় আট মাস ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে রুশ আগ্রাসনের কারণে মস্কোর বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তেল উৎপাদন বাড়ানোর চাহিদা জানালেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন তেল-উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
মার্কিন মিত্র হলেও রিয়াদের এই সিদ্ধান্ত কার্যত রাশিয়ার পাশে থাকার সমান। এতে করে বাইডেন প্রশাসনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং সর্বশেষ সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট বাইডেন পুনঃমূল্যায়ন করছেন বলে জানাল হোয়াইট হাউস।
আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস মঙ্গলবার বলেছেন, আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে ও বিদেশে মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনা করছে।
নেড প্রাইস বলেন, ‘আমরা কোথায় আছি তা পর্যালোচনা করছি; আমরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে তা পর্যবেক্ষণ করবো, অংশীদার ও মিত্রদের সঙ্গে কথা বলবো।’
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল মঙ্গলবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সৌদি আরবকে পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সিএনএনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমি কি বিবেচনা করতে পারি আর কি ভাবছি, সেটা বলবো না। কিন্তু এক্ষেত্রে (তেলের উৎপাদন কমানো) অবশ্যই পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ তবে ঠিক কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেই সম্পর্কে কিছু বলেননি বাইডেন।
এর আগে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি সিএনএনকে বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করতে ‘ইচ্ছুক’।
ওপেক ও রাশিয়া মিলে সম্প্রতি জ্বালানি তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আমেরিকার মধ্যবর্তি নির্বাচনের আগে ভোক্তা পর্যায়ে তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
নেড প্রাইস অভিযোগ করে বলেন, ওপেক প্লাস আমেরিকানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
সৌদি ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক এবং রাজপরিবারের কঠোর সমালোচক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরবকে আন্তর্জাতিকভাবে ‘প্যারিয়াহ’ বা অস্পৃশ্য রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি সফর করেন। এমনকি সেসময় তিনি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথেও দেখা করেছিলেন।
সৌদি এবং আমিরাতের তেল উৎপাদন হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই দুই দেশ যে রাশিয়ার পাশে থাকার পথ বেছে নিয়েছে তা পরিষ্কার। মূলত ওপেক প্লাস তেলের উৎপাদন কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রাশিয়ার তেল রপ্তানির আয় বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
এদিকে নভেম্বরের আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে পেট্রোলের দাম কম রাখার আশায় ওপেকের তেল উৎপাদন কমানোর এই সিদ্ধান্ত ঠেকাতে বেশ জোরেশোরে চেষ্টা করেছিল বাইডেন প্রশাসন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম বাড়লে সেটির প্রভাব নভেম্বরের নির্বাচনের ওপর পড়তে পারে এবং এতে করে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।
তবে সৌদি আরব বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধি এবং বিশ্ব মন্দার সম্ভাবনার মধ্যে তেলের বাজারকে স্থিতিশীল রাখার কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এছাড়া মঙ্গলবার সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল-আরাবিয়া চ্যানেলকে বলেন, তেল উৎপাদন কমানোর পদক্ষেপটি ‘পুরোপুরিভাবে অর্থনৈতিক এবং (সংগঠনের) সদস্য দেশগুলো সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওপেক প্লাস সদস্যরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেছে এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে’।
এর একদিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জ্বালানি মন্ত্রী সুহেল আল-মাজরুই বলেন, তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত ছিল ‘প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক নয়’।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলছেন, (সৌদি আরবের সাথে) ‘সম্পর্ক ঠিক কিভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে তা নির্ধারণে কংগ্রেসের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক’ প্রেসিডেন্ট বাইডেন। অবশ্য এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি বলেও স্পষ্ট করেছেন তিনি।
রয়টার্স বলছে, মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির ডেমোক্র্যাটিক চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজ ওয়াশিংটনকে সৌদি আরবের সাথে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করার আহ্বান জানানোর একদিন পর জন কিরবির এই মন্তব্য সামনে এসেছে।
এছাড়া গত বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসের তিন সদস্য ডেমোক্র্যাট দলীয় সিন ক্যাস্টেন, টম ম্যালিনোস্কি এবং সুসান ওয়াইল্ড এক যৌথ বিবৃতি দেন। সেখানে তারা বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বান সত্ত্বেও সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলের উৎপাদন ব্যাপক পরিমাণে হ্রাসের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শত্রুতামূলক কাজ।
তাদের যুক্তি, সৌদি এবং আমিরাতের তেল উৎপাদন হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই দুই দেশ যে রাশিয়ার পাশে থাকার পথ বেছে নিয়েছে তা পরিষ্কার। মূলত ওপেক প্লাস তেলের উৎপাদন কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রাশিয়ার তেল রপ্তানির আয় বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির শূন্যস্থান পূরণে সৌদি আরব শুধু যে রাশিয়াকেই ভরসাস্থল মনে করছে, তা নয়। বিকল্প মিত্র হিসেবে সৌদি সরকার ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের কথাও ভাবছে এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা বাড়িয়ে সম্পর্ককে দৃঢ় করছে। সৌদি আরব স্থানীয়ভাবে অস্ত্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চীন ও অন্যদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগও চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের (এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত) কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রিতে বাধা তৈরি করেছে। এ ছাড়া ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব যে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে গোয়েন্দা ও রসদ সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছে ওয়াশিংটন।
এর কোনোটিই সৌদি আরবকে আমেরিকান অনুরোধ রাখার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত করেনি। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের সুবিধা নিশ্চিত করতে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়িয়ে বিশ্ববাজারে দাম কমিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। সৌদি সরকার তখন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিল, এবারও ঠিক একইভাবে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সৌদির আচরণে বোঝা যাচ্ছে, তারা শুধু তখনই তেলের দাম বাড়াবে, যখন তাদের নিজেদের প্রয়োজন হবে। তারা আমেরিকার পক্ষ নিয়ে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। তারা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকেও ঝুঁকিতে ফেলবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২১
আপনার মতামত জানানঃ