২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পোপ ফ্রান্সিসের একটা সতর্কবার্তা দিয়ে শুরু করা যাক। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পানির স্বল্পতা বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানি পাওয়ার অধিকার অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। পানি হবে ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের ৬৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ পানযোগ্য পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মানসম্মত পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে আরও প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ।
তবে শুধু মানুষ না, ভুক্তভোগী বন্যপ্রাণীরাও। শুকিয়ে গেছে তৃণভূমি। শুকনো প্রান্তরে এখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ। কেনিয়ার ছবি বর্তমানে এমনটাই। বিগত চার দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ খরার শিকার কেনিয়া। বিগত তিন মাসে এক ধাক্কায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর হার। পাশাপাশি খরার কারণে মানুষের সঙ্গেও সংঘাত বাড়ছে তাদের।
কেনিয়া গ্রেভি’স জেব্রার সবচেয়ে বড়ো আবাসস্থল। বিশ্বজুড়ে বিরল প্রজাতির এই জেব্রার সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার। যার মধ্যে আড়াই হাজার গ্রেভি’স জেব্রার বাসস্থান কেনিয়া। অথচ, খাদ্য এবং পানীয়ের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তারা।
কেনিয়া সরকার এবং কেনিয়ার ‘গ্রেভি’স জেব্রা ট্রাস্ট’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত সপ্তাহে ৪০টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি সপ্তাহে ১ শতাংশ কমেছে জেব্রার সংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অবলুপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে এই প্রজাতিটি।
তবে শুধু জেব্রাই নয়। হাতি, হিরোলা, সেবন ও রোয়ান অ্যান্টিলোপ-সহ একাধিক প্রজাতির প্রাণীর মধ্যেই দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে ৫০টির বেশি হাতি। হাতির মৃত্যুর এই হার স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বেশি। অরণ্য এবং তৃণভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল শুকিয়ে যাওয়ায় খাদ্যের সন্ধানে অধিকাংশ সময়েই লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বন্যপ্রাণীরা। এমনকি হাতির তাণ্ডবে বেশ কয়েকটি জায়গায় ধ্বংস হয়েছে শস্যাগার।
পানির অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে কেনিয়ায়। বড়ো মাত্রার দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ভুগছে পূর্ব আফ্রিকার দেশটি। তার মধ্যে সঞ্চিত শস্যভাণ্ডারে বন্যপ্রাণীরা আক্রমণ করলে, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা গবেষকদের।
অন্যদিকে বন্যপ্রাণীদের এই সংকট প্রভাবিত করছে সে-দেশের অর্থনীতিকেও। কেনিয়ার অর্থনীতির একটা বড়ো অংশ নির্ভর করে পর্যটন শিল্পের ওপর। প্রতিবছর সেখানকার অভয়ারণ্য ও বন্যপ্রাণী পরিদর্শনের জন্য হাজির হন অসংখ্য বিদেশি পর্যটক। আজ এইসব অভয়ারণ্যে ছড়িয়ে রয়েছে মৃত পশুপাখির শবদেহ। দুর্গন্ধে সেখানে টিকে থাকাও দায় মানুষদের। ফলে, ক্রমশ কমছে পর্যটকদের আনাগোনা। পাশাপাশি পচনশীল দেহ থেকে বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর আশঙ্কাও বাড়ছে ক্রমশ।
পরিস্থিতি বাগে আনতে মাঠে নেমেছেন কেনিয়ার রেঞ্জাররা। তবে বিস্তীর্ণ অরণ্যের চেহারা রাতারাতি বদলে ফেলে আদৌ কি সম্ভব মানুষের পক্ষে? প্রাথমিকভাবে তাঁদের লক্ষ্য, প্রাণীমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে আনা। খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ করতে অভয়ারণ্যগুলিতে জায়গায় জায়গায় তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম জলাশয়। তাছাড়াও সেখানে গুড়, খড়, লবন ও ক্যালশিয়ামের সরবরাহ বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রেঞ্জাররা। তবে মাস দুয়েকের মধ্যে বৃষ্টি না হলে, কোনোভাবেই আয়ত্তে রাখা যাবে না পরিস্থিতিকে।
বিশ্ব জুড়ে পানির সঙ্কট
তবে পানির সঙ্কট এখন গোটা বিশ্ব জুড়েই। ইউনিসেফের এক জরিপ বলছে, চীনের ১০ কোটি ৮০ লাখ, ভারতের ৯ কোটি ৯০ লাখ ও নাইজেরিয়ার ছয় কোটি ৩০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্য দিকে ইথিওপিয়ায় চার কোটি ৩০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় তিন কোটি ৯০ লাখ ও পাকিস্তানে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ সুপেয় পানি পান না।
আমাদের দেশেও আছে চরম সঙ্কট। এখানে প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ লোক পানি সঙ্কটের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে ২৬০টির বেশি আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা রয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এসব নদীর ওপর নির্ভরশীল; যে কারণে শত শত আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পানি সম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে। এই চাপ মোকাবেলায় নদী অববাহিকায় উজানের দেশগুলো গড়ে তুলেছে বিশালাকার বাঁধ বা ড্যাম। যার খেসারত ভাটির প্রাণ ও প্রকৃতিকে দিতে হচ্ছে। এসব নদনদীর পানির হিস্যা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সম্পর্কের অবনতি, যা দেশগুলোর মধ্যকার ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশগুলোর চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে শত শত আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি টিকবে কি না, তা নিয়ে নতুন করে তৈরি হচ্ছে ধোঁয়াশা।
এর একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ হচ্ছে নীল নদ নিয়ে ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ নির্মাণ প্রকল্প। তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যকার বিবাদের আড়ালে ও রয়েছে ইউফ্রেটিস নদীর পানি বণ্টনজনিত সমস্যা। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বহু দেশ লড়ে যাচ্ছে পানির জন্য। নীল নদের ওপর রেনেসাঁ ড্যাম তৈরির জের ধরে ইথিওপিয়া ও মিসরের দ্বন্দ্ব নিয়ে চিন্তিত বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টি এসেছে ভারতের মধ্য দিয়ে, তিনটি এসেছে মিয়ানমার থেকে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হিসেবে নদীগুলোর পানির নায্য হিস্যার দাবিদার। অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪৭টি নদীর গতিপথে ছোটবড় পাঁচ শতাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এতে প্রবাহ কমে শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সাগরের পানি ঢুকে ভাটি অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে। আবার বর্ষাকালে বন্যার তোড়ে এতদঞ্চলের পানীয় জলের স্থানীয় উৎসগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। মোট কথা বাংলাদেশের পানীয় পানির সমস্যা দিন দিন ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
পানিশূন্য পৃথিবী
গত ১০ বছর ধরে নাসার গ্রেস (GRACE) স্যাটেলাইট পৃথিবীর পানির পরিমানের উপর নজর রাখছে। নাসার গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৩৭টি এ এক্যুইফারের (ভূগর্ভস্ত পানির স্তর যেখান থেকে নলকূপের সাহায্যে পানি উঠানো যায়) অর্ধেকেই আশঙ্কাজনকহারে পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। যদিও এই স্তরগুলো আবারও পানি দিয়ে ভরে উঠতে পারে, কিন্তু সে সম্ভাবনা খুবই কম।
ভূগর্ভের এক্যুইফারগুলো লাখ লাখ মানুষকে বিশুদ্ধ পানির যোগান দেয়। এদের মধ্যে ২১টি এক্যুইফারে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে যে পরিমাণ পানি খরচ হয়েছে সে পরিমাণ পানি আবার ভর্তি হতে পারেনি। আরব অঞ্চলের এক্যুইফারগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। প্রতিটি এক্যুইফার গড়ে ৬০ লাখ মানুষকে পানি সরবরাহ করে।
আপনি যদি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন হন যার কিনা পানি পেতে শুধু একটা কল খুলতে হয়, তবে আপনার জন্য পৃথিবীর বাকি মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র তুলে ধরতে চাই। প্রতিদিন নারী ও কিশোরীরা সামষ্টিকভাবে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি ঘন্টা ব্যয় করে শুধু বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষের কোন স্বাস্থ্যসম্মত সৌচাগার নেই। গড়ে প্রতি দুই মিনিটে একটি ৫ বছর বা তার কম বয়সী শিশু মারা যাচ্ছে পানিবাহিত রোগে।
পানি যদি বর্তমান হারেই খরচ হতে থাকে, তবে দশ বছর পর পৃথিবীতে আমাদের প্রয়োজনের শুধুমাত্র ৬০% পানি থাকবে। এখন থেকে বিশ বছর পর পৃথিবীর সকল মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর পানিই থাকবে না। তারও দশ বছর পর, ২০৫০ সালে খরাকবলিত স্থলভূমির পরিমান বাড়বে ৫ গুণ, তীব্র পানি সংকটে পড়বে ৫ বিলিয়নেরও এই ভয়াবহ তথ্যাবলী আমাদের কাছে থাকা সত্ত্বেও, পৃথিবীতে পানির অপচয় চলছে আপন গতিতে।
বিজ্ঞানীরা বারংবার সাবধানী বাণী শুনিয়েছেন বিশ্বনেতাদের। বিবিধ বৈশ্বিক অধিবেশনে পলিসি দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু যে নিদারুন পানি সংকটের দিকে আমরা ধাবমান, তা ঠেকাতে তৃণমূল পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হচ্ছে তা বলা যায় না।
আমরা এখন শৌচকর্মটাও করি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, গোসলের সময় পানি ছেড়ে গান ধরি; আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে পদে পদে পানি অপচয় করে যাই নিজের অজান্তেই। আমাদের বর্জ্য আমরা নিশ্চিন্তে ঢেলে দিচ্ছি জলধারায়, দূষণ ও খরায় নদী-নর্দমা আলাদা করা যায় না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ