বিশ্বে মহাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে একত্রে কাজ করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও যুক্তরাষ্ট্রের এক মেরু বিশ্বব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন এবং তারা বিশ্বে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এক সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।
গতকাল উজবেকিস্তানের সমরখন্দে আয়োজিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে মুখোমুখি হয়ে এই অঙ্গীকার করেন শি জিনপিং ও পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম মুখোমুখি বৈঠক করেছেন দুই নেতা। পুতিন ইউক্রেন নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি উদ্বিগ্ন বলেও স্বীকার করেছেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গেও বৈঠক করেন। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও বৈঠক হওয়ার কথা তার।
বৈঠকে শি জিনপিং পুতিনকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা করোনা মহামারিকে কাটিয়ে উঠেছি। এর মধ্যেও আমাদের বহুবার ফোনে কথা হয়েছে। আমরা আমাদের কৌশলগত সম্পর্ককে সর্বদাই গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। শি পুতিনকে ‘পুরোনো বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে চীন মহাশক্তির দায়িত্ব প্রদর্শনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক এবং বিশৃঙ্খলার বিশ্বে স্থিতিশীলতা এবং ইতিবাচক শক্তি স্থাপন করতে চায়।
শি জিনপিং বলেন, চীন পরস্পরের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের মহাশক্তি হিসাবে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।
অপর দিকে প্রেসেডন্ট পুতিন বলেন, ‘ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের চীনা বন্ধুদের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করি। আমরা এই বিষয়ে আপনার প্রশ্ন এবং উদ্বেগ বুঝতে পেরেছি। আজকের বৈঠকে আমরা অবশ্যই আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করব।’
পুতিন চীনের উদ্বেগ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি। যদিও এটা মনে করা হয় যে ইউক্রেনের ওপর মস্কোর হামলার প্রতি চীনের সমর্থন সীমাহীন নয়। চীন রাশিয়ার জন্য তার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবে না।
চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পরেই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় সরব হন পুতিন। তিনি বলেন, আমেরিকা এক মেরু একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছে। এজন্য যে ভয়ংকর রূপ দেখাচ্ছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলেও দাবি করেছেন পুতিন। এই প্রসঙ্গেই চীনের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার দাবির পক্ষেও কথা বলেন পুতিন। তিনি ‘এক চীন নীতি’র প্রতি তার আস্থা থাকার কথা জানান। তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর সমালোচনা করে পুতিন বলেন, ‘তাইওয়ান প্রণালিতে আমেরিকার প্ররোচনা সৃষ্টির চেষ্টার আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’ পুতিন চীনের সঙ্গে জ্বালানি নিয়ে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলবেন বলেও জানান।
চীন পরস্পরের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের মহাশক্তি হিসাবে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।
চীন ও রাশিয়ার উষ্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি দুই দেশের নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কও বেশ উষ্ণ। অসংখ্যবার তারা সাক্ষাৎ করেছেন।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া। তবে চীন সরাসরি রাশিয়ার প্রতি সমর্থন না জানালেও সামরিক অভিযান নিয়ে নিন্দা করা থেকে বিরত থাকে এবং রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশটি থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বেইজিং।
এসসিও’র এই শীর্ষ সম্মেলনকে অনেকে দেখছেন পশ্চিমা বিশ্বে ন্যাটোর মত জোটগুলোর প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য একটি পালটা জোট হিসেবে। বর্তমান বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এই সম্মেলনের ওপর ছায়া ফেলেছে। দুই বছর কোভিড মহামারিতে বন্ধ থাকার পর এই বছরই ফের বসেছে এই সম্মেলনের আসর। চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানকে নিয়ে গঠিত এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে সদস্য দেশগুলো পারস্পরিক নিরাপত্তা, শক্তিসাম্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
প্রসঙ্গত, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিলিত হন বিশ্বের কয়েকটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা।
এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খড়গে ‘রক্তাক্ত’ ইরান। সেই অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থায় ঢুকতে চায় তেহরান। সেই লক্ষ্যে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো ‘বাঘা’ দেশগুলোর গড়া সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর সদস্যপদ পেতে এক ধাপ এগিয়েছে দেশটি।
বৃহস্পতিবার উজবেকিস্তানের সমরকন্দে শুরু হওয়া সংস্থাটির দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনেই সদস্যপদ প্রাপ্তির বাধ্যবাধকতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে ইরান। সম্মেলনে অংশ নিতে ইতোমধ্যে উজবেকিস্তানে রয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও অন্য নেতারা। শুক্রবার শেষ হবে এ শীর্ষ সম্মেলন।
মধ্য এশিয়ায় পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঢাল হিসাবে ২০০১ সালে গঠিত হয়েছিল এসসিও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এই জোটের অন্য সদস্য দেশগুলো হচ্ছে পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান। এর পর্যবেক্ষক দেশ হিসাবে রয়েছে আফগানিস্তান, বেলারুশ, মঙ্গোলিয়া ও ইরান। সংস্থাটির সংলাপ অংশীদার হিসাবে রয়েছে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলংকা ও তুরস্ক।
গত বছর এ জোটের পূর্ণ সদস্য হওয়ার আবেদন করেছিল ইরান। চলতি সম্মেলনের প্রথম দিনেই আলোচনায় বাজিমাত করেছে ইরান। দেশটির অন্যতম রাজনীতিক হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান ইনস্টাগ্রাম পেজে লিখেছেন, ‘এসসিওর পূর্ণ সদস্যপদ পেতে নথিতে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ইরানের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, ট্রানজিট ও জ্বালানি সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।’
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট রাইসি রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সম্পন্ন করেছেন। সংস্থার ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল গ্রেগরি লগভিনভ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে স্বাক্ষরের খবর দিয়ে জানিয়েছেন, সংস্থার পূর্ণ সদস্যপদ পেতে ইরানের কিছুটা সময় লাগতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২১
আপনার মতামত জানানঃ