আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য চড়া রয়েছে। চীনের মতো বড় পণ্য প্রস্তুতকারক অর্থনীতির জন্য যা রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু, দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির ভাগ্যের চাকা খুলে দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার ফলে মস্কোর ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা।
রাশিয়াকে এসব নিষেধাজ্ঞা নাগপাশ কাটাতে ভারত ও চীনসহ বড় ক্রেতাদের কাছে সুলভে বিক্রি করতে হচ্ছে জ্বালানি তেল। ছাড়কৃত মূল্যে তেল বিক্রি করে চীনের জ্বালানি তেলের বাজার মাত করছে রাশিয়া। বেইজিংয়ের কাছে এরমধ্যেই বিক্রি করেছে অন্য যে কোনো রপ্তানিকারকের চেয়ে বেশি।
মে মাসের আমদানি তথ্য অনুসারে, এ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি তেল কিনেছে চীন। ফলে গত মে’তে- সৌদি আরবকে পিছু হটিয়ে চীনে প্রধান তেল বিক্রিকারী দেশ হয়েছে রাশিয়া।
আমদানির তথ্য আরও নির্দেশ করে যে, কোভিড বিধিনিষেধের কারণে চীনের অর্থনীতি আগের চেয়ে কিছুটা গতি হারানোর পরও রাশিয়া থেকে তেল কেনা বেড়েছে দেশটির। অর্থাৎ, চীন চাহিদার চেয়ে বেশি তেল কিনেও মজুদ করছে। জ্বালানির আগুন দরের বিশ্ববাজার পরিস্থিতিতে মস্কোর দেওয়া মূল্যছাড় চীনকে আকৃষ্ট করছে আরও বেশি।
তবে এতে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ থাকতেও পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে শীতকালীন অলিম্পিকে যোগ দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এসময় তিনি তার চীনা প্রতিপক্ষ শি জিনপিং এর সাথেও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন- এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
গত ফেব্রুয়ারির ইউক্রেন যুদ্ধপূর্ব ওই সময়ে এক যৌথ ঘোষণা দেয় চীন ও রাশিয়া। এতে বলা হয়, উভয় দেশের বন্ধুত্ব ‘অনন্ত’। অর্থাৎ, এই সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখায় বাঁধাধরা নয়- এমন বার্তা দেওয়া হয়।
পশ্চিমা গণমাধ্যম ইঙ্গিত দিতে চাইছে, হয়তো একারণেই চীন যুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার তেল কেনা বাড়িয়েছে। তবে মূল্যছাড়ের দিকটি অস্বীকার করেনি বিবিসি। গণমাধ্যমটি জানাচ্ছে, মস্কো বিপুল ছাড় দেওয়ায় গত কয়েক মাস ধরেই বাড়ছিল চীনের রাশিয়ান ক্রুড (অপরিশোধিত তেল) ক্রয়। ইউরোপ ও আমেরিকা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার তেল কেনা কমাচ্ছে। দিয়েছে ভবিষ্যৎ রপ্তানি দুরূহ করার মতো বিধিনিষেধ। আর সেকারণে মস্কো আকর্ষণীয় মূল্যে ক্রুড বিক্রি করছে।
বৃহত্তম প্রতিবেশী চীনে পাইপলাইন ও জাহাজ দুভাবেই তেল রপ্তানি করে রাশিয়া। প্রধান পাইপলাইন হলো- ইস্ট সাইবেরিয়ান পাইপলাইন। উভয় ব্যবস্থায় গত মাসে মোট ৮ লাখ ৪২ হাজার টন ক্রুড রপ্তানি করেছে রাশিয়া। চীনের শুল্ক কর্তৃপক্ষ- চাইনিজ জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমস জানিয়েছে এসব তথ্য।
আগের মাসগুলোয় চীনের শীর্ষ ক্রুড রপ্তানিকারক ছিল সৌদি আরব। তবে মে’তে সৌদির ৭ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টনকে ছাড়িয়ে যায় মস্কোর সরবরাহ।
রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। গত মার্চেই রাশিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ইউরোপিয় ইউনিয়নও চলতি বছরের শেষদিকে সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। এভাবে মস্কোকে ইউক্রেনে আগ্রাসনের শাস্তি দিতে চাই পশ্চিমারা।
কিন্তু, তাতে কেবল বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামই আকাশ ছুঁয়েছে। সাধারণ ভোক্তারাও এখন সস্তায় জ্বালানি পেতে উন্মুখ। এই বাস্তবতায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির ডিসকাউন্ট মূল্যে তেল কেনার আগ্রহ অস্বাভাবিক নয়। একই কারণে ভারতও রাশিয়ার তেল কেনা বাড়িয়েছে।
ক্রুডের মূল্যবৃদ্ধি এবং নয়া-ক্রেতাদের এই আগ্রহের কারণে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির আয় বেড়েছে যুদ্ধ শুরুর পরবর্তী সময়ে।
যুদ্ধের আগে চীন যদি রাশিয়ার ১০ ব্যারেল ক্রুড তেল কিনতো; তার বিপরীতে একটি কিনতো যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এই এক ব্যারেলের ক্রেতার যে ঘাটতি তা সহজেই পূরণ করে দিচ্ছে চীন।
তবে এরমধ্যেই কিছুটা কমতে শুরু করেছে রাশিয়ার তেল বিক্রির আয়। জ্বালানির বিকল্প উৎসে ইউরোপের অন্য ক্রেতারা চলে গেলে তা আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ও একে কেন্দ্র করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার দরুন জ্বালানির দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর গ্যাসের এমন লাগামহীন দাম বৃদ্ধির জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে’ দুষলেন মার্কিন তেল ও গ্যাস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান টিম স্টুয়ার্ট।
শনিবার (১৮ জুন) ‘ক্যাভুটো লাইভ’ নামক এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে বাইডেন প্রশাসনের পরিকল্পনার ব্যর্থতা একটি জরুরি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এটি নেতৃত্বের এক বিশাল ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
গত শনিবার (১১ জুন) যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি গ্যালন গ্যাসোলিনের দাম ছাড়ায় ৫ ডলার। তবে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কিছুটা কমে ৪.৯৯ ডলারে এসে ঠেকেছে। তারপরেও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এই দাম অনেক বেশি বলেই উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলমান সংঘাত ও অবরোধের প্রভাবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বিগত চার দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে মুদ্রাস্ফীতি।
আর এসবের প্রভাব মোকাবেলায় সুদহার বাড়িয়েছে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ। গেল বুধবার (১৫ জুন) যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর কথা জানায় সংস্থাটি। ১৯৯৪ সালের পর এই প্রথম সুদহার এতটা বাড়ানো হয়েছে দেশটিতে।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধির জন্য তেল ও গ্যাস শিল্প কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না বলে জানান টিম স্টুয়ার্ট। তিনি বলেন, “বুধবার তারা (বাইডেন প্রশাসন) দাম বৃদ্ধির জন্য তেল ও গ্যাস শিল্পের ওপর অভিযোগ এনেছে; আমরা নাকি সমাধানে যথেষ্ট করছি না। অথচ আমরা এখন আমাদের পরিশোধন ক্ষমতার ৯৫ শতাংশ ব্যবহার করছি।”
এদিকে, জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ‘জরুরি ক্ষমতা’ ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন। তবে, এই পদক্ষেপ হোয়াইট হাউস প্রশাসনের বিগত ১৮ মাসে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে বদলে দেবে না বলে উল্লেখ করেন স্টুয়ার্ট।
তিনি বলেন, এই সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে বিশেষ কথোপকথনের সময় উত্পাদন এবং সরবরাহ বাড়াতে জরুরি ক্ষমতা আহ্বানের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। এখানে বিড়ম্বনার বিষয় হল, এর মাধ্যমে কী গত ১৮ মাসে নেওয়া তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোকে তারা বদলাতে পারবেন? এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য যে, যদি তারা এটি করেন তাহলে আমরা সেই পথেই এগোবো।
এদিকে, জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্কট যা দেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রতিবাদ জানাতে হাজার হাজার লোক লন্ডনের রাস্তায় নেমেছে। প্রতিবাদকারীরা পোর্টল্যান্ড প্লেসের আশেপাশে জড়ো হয়েছিল এবং সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার এবং সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছিল।
সেখান থেকে জনতা মিছিল করে পার্লামেন্ট স্কয়ারের দিকে, যেখানে বক্তারা জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা বিতর্কিত পুলিশ এবং অপরাধ বিলের সমালোচনা করেছেন যা ভবিষ্যতে এই ধরনের বিক্ষোভকে সীমিত করতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। জনসমাগমের মধ্যে ব্যানার দেখা যায়, ‘যুদ্ধ পরিহার করুন, কল্যাণ নয়’ এবং ‘ঘরে ঘরে জ্বালানির সঙ্কটের অবসান ঘটাও’।
আরও স্লোগান ছিল, ‘বোমা না বানিয়ে সেবা করুন’, ‘রাগ করবেন না, সক্রিয় হোন’ এবং ‘অ্যাসাঞ্জকে মুক্তি দাও’। বিক্ষোভ ওয়েস্টমিনস্টারের দিকে যাওয়ার সময় ভিড়ের মধ্যে বিক্ষোভকারীদের শিস, উল্লাস এবং হাততালি শোনা যায়। টিইউসি প্রতিবাদটি সংগঠিত করেছে, ইউনিয়নের দ্বারা পরিচালিত গবেষণার পর পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে, শ্রমিকরা ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ২০ হাজার পাউন্ড হারিয়েছে কারণ বেতন মুদ্রাস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলেনি।
বিক্ষোভে বেন রবিনসন (২৫) যিনি দক্ষিণ লন্ডনের ব্রিক্সটনে একটি হাউজিং দাতব্য সংস্থার জন্য কাজ করেন, তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অফিসে অনেকেই সাহায্যের জন্য আসছেন, যারা নিজেরা না খেয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবার এবং ঘর গরম করার জন্য জ্বালানি চাইছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য এটি একেবারেই বেমানান।’
এসডব্লিউ/এসএস/১০৪৮
আপনার মতামত জানানঃ