গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম
নগদ নিয়ে সাম্প্রতিক হইচই, এক্সিম ব্যাংকের দায়দেনা সমন্বয়, গ্রাহকের টাকা আসলে আছে নাকি নাই, এইসব বিতর্ক নিয়ে জনাব সোলায়মান সুখন (নগদ এর ডিরেক্টর, পাবলিক এফেয়ার্স) গতকাল একটি ব্যাখ্যামূলক ভিডিও প্রকাশ করেছেন। তিনি সেখানে কী কী যুক্তির অবতারণা করেছেন, কেন সেগুলো অসত্য ও কুশলী ভাওতাবাজি, তা নিয়ে ‘পইপই’ আলাপের আগে বলতে চাই-
তিনি থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড এর সিআইবি রিপোর্ট পাবলিকলি ডিসক্লোজ করে সম্ভবত একটি অপরাধ করেছেন। তিনি বোর্ডে আঁকাআঁকি করে আমাদের যা পড়াচ্ছিলেন, ঠিক তার উপরেই একটি নির্দেশনা ছিল, যা বলছে- The CIB report is strictly confidential and not to be disclosed to the borrower or any other party. এরপর যা বলা আছে, সেখানে রেফার করা আছে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার এর ৪৮ এর ২ ধারা উল্লেখপূর্বক, যার লঙ্ঘন হলেঃ
48 (2) If any person discloses any credit information, the disclosure of which is prohibited under Article 46, he shall be punishable with imprisonment which may extend to six months or with fine which may extend to [Taka one lakh] or with both.
আর্টিকেল ৪৬ যা বলছে
46. (1) Any credit information contained in any statement submitted by a banking company under Article 44 or furnished by the Bank to any banking company under Article 45 shall be treated as confidential and shall not, except for the purposes of this Chapter, be published or otherwise disclosed
জনাব সুখন কিংবা তার প্রতিষ্ঠান নগদ যে আর্থিক খাতের কমপ্লায়েন্সের ন্যূনতম তোয়াক্কা করেন না, এটি তার একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ।
এবার আসেন নগদ এর জন্মের ইতিহাস নিয়ে, সেখানে বিপুল পরিমাণ নন-কমপ্লায়েন্স, ও রাজনীতির শক্তিতে আইন কানুন তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরে মাস্তানির প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোকপাত করি! যার বিস্তারিত আপনারা নেত্র নিউজের রিপোর্টের মাধ্যমে বছরখানেক আগেই অবগত।
আরও কিছু প্রেক্ষাপট এখানে খোলাখুলি বলি। (প্রশ্ন করতে পারেন, আমি কীভাবে জানি? কারণ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এর রেগুলেশন, ইনোভেশন ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভেতরে ও বাইরে অনেক কিছুই কর্মসূত্রে আমি ২০১৭ সাল থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়া ও প্যাসিফিক জুড়ে)
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) খাতে বাজারে কে খেলবে আর কে পারবে না এটা বাংলাদেশে শুধু না, বিশ্বজুড়েই এই রেগুলেশন বিলিয়ন ডলারের রাজনীতির বিষয়। এখন বিকাশ বা নগদে টাকা প্রেরণের যে ব্যবসা আমরা দেখি, তা এই খাতে আগামী দুই তিন দশকে সম্ভাব্য ব্যবসার শতকরা এক ভাগ (খেয়াল করেন- বলেছি মাত্র ১%)। আগামীর ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবার পুরোটাই ডিজিটাল, তাই এই খাতের নিয়ন্ত্রণ আগেভাগে কারা নিতে পারে তা নিয়ে লড়াই চলে আসছে কেনিয়া, ভারত, তানজানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, পাকিস্তান, আমাদের বাংলাদেশেও, সেই ২০১১ সাল থেকে। মোটাদাগে বলতে গেলে দুটো মডেলে এই খাতে রেগুলেশন প্রবর্তিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে, টেলিকম কোম্পানি লেড মডেল আর ব্যাংক লেড মডেল।
বাংলাদেশ ‘ব্যাংক লেড মডেল’ বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি দৃঢ়তায়, ফলে এমএফএস এ বিনিয়োগ করতে হলে কোন শিডিউল্ড ব্যাংকের কমপক্ষে ৫১% মালিকানা থাকতে হবে এমএফএস কনসার্ন এ, গঠন করতে হবে আলাদা সাবসিডিয়ারি। টেলিনর বা আজিয়াটা গ্রুপ, টেলিকম খাতের বৈশ্বিক কোয়ালিশন জিএসএমএ (GSMA) এর প্রভাবশালী বেশ কিছু আগ্রহী টেলকো লবি এখানে ব্যবসার সুযোগ পেতে বহু দেন দরবার করেছে প্রধানমন্ত্রী থেকে তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা পর্যন্ত সবার কাছে, লাভ হয়নি। ২০১৪ এর শেষভাগে এমএফএস রেগুলেশনের খসড়া তৈরি হয়ে চার বছর আটকে থেকে ঘুরপাক খেয়েছে নানা গোষ্ঠীর সুযোগ পাওয়া না পাওয়ার টানাটানিতে, শেষমেশ টেলকোদের বড়জোর সহযোগী মাস্টার এজেন্ট হবার সুযোগ রেখে নীতিমালা সংস্কার হয়েছিল ২০১৮ তে। টেলিনর এই বাজারে আর ঢুকতে পারেনি, আজিয়াটা গ্রুপ (রবির প্যারেন্ট কোম্পানি) শেষমেশ ট্রাস্ট ব্যাংকের সাথে পার্টনারশিপে বাজারে এসেছে, তাও অনেকটাই ট্রাস্ট ব্যাংকের মিলিটারি মাসল এর সাহায্যে।
এইসব রাজনীতির খবর এই খাতের সংশ্লিষ্টরা ছাড়া বাইরের তেমন কেউ জানেন না, বললাম এই কারণে যে ‘নগদ’ এর উদ্যোক্তারা এই খাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় আসা প্রথম কেউ না, এর আগে অনেকেই এসেছেন।
এখন এক দশক পর এসে একটা বড় পলিসি ইভালুয়েশনের প্রশ্ন এই সেক্টরে, যে টেলকোদের শুরু থেকেই খেলতে দিলে বিকাশ এর বাজারে বিশাল আধিপত্য না হয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজার হত কিনা, যেখানে গ্রাহক হয়তো আরও বিস্তৃত সেবা কম খরচে পেত! যাক, সেটা অন্য আলোচনা!
তবে প্রেক্ষাপটটা জানা জরুরি, কারণ জনাব সুখন বারবার বোঝাতে চাইছেন যে কম রেইটে সার্ভিস দিয়ে, বাজারে প্রতিযোগিতা এনে আদতে নগদ গ্রাহক সেবা করছে। অলমোস্ট মনোপলি মার্কেটে বিকাশের আধিপত্য খর্ব করে জাতীয় কল্যাণে মহান অবদান রাখছে!
এইসব বাকোয়াজ শোনার সাথে সাথে প্রশ্ন হল, নগদ এই মহান অবদান রাখার জন্য বাজারে যখন এসেছিল, তখন কি নিয়ম কানুন মেনে এসেছিল?
টেলিনর বা রবি যেখানে সব নিয়ম কানুন মেনে ব্যবসা করতে চেয়ে সফল হতে পারেনি, ‘নগদ’ এর উদ্যোক্তারা সব রেগুলেশন বাইপাস করে পেরেছেন, কোন শক্তিতে সেটা আপনারা সবাই বুঝেন, তাদের মালিকানায় কাদের নাম আছে সেদিকে তাকালেই স্পষ্ট হয় তা (নেত্র নিউজ এর প্রতিবেদন দ্রষ্টব্য)।
‘নগদ’ তথা থার্ড ওয়েভ শুরুতে এমএফএস গাইডলাইনের আওতায় থেকেই কার্যক্রম চালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গিয়েছিল, কিন্ত কোন ব্যাংকের সিংহভাগ মালিকানা না থাকায় ও আর্থিক সেবা কার্যক্রমের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায়, একই সাথে নির্ভরযোগ্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এর নিশানা দেখাতে না পারায় বিধি অনুসারেই তারা অনুমোদন পায়নি।
যেহেতু এর উদ্যোক্তারা স্মার্ট, তাই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশনের আওতার একেবারে বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শরণাপন্ন হলেন বাংলাদেশ পোস্টাল অ্যাক্ট ২০১০ এর সংশোধিত দলিলের। ডাক বিভাগ যেহেতু অর্থ লেনদেন করতে পারে এই অ্যাক্ট অনুযায়ী (ডিজিটাল বা মোবাইল ওয়ালেট সংক্রান্ত কিছু বলা নাই), তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো গেল, অবশ্য যুক্তির চেয়ে এখানে ক্ষমতার জোর বেশি। কারণ পেমেন্ট সিস্টেম রেগুলেশন্স, ২০১৪ অনুসারে সকল প্রকার (ডিজিটালসহ) লেনদেন এর রেগুলেশনের এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের, এখানে সরকারের কোন সংস্থা তার সাথে কমপ্লাই করতে বাধ্য কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরির কোনই অবকাশ নেই।
যেকোন নতুন প্রযুক্তির রেগুলেশনের বিশদতার অভাব থাকেই, সেই ফাঁক কে নিজেদের ধান্ধায় ব্যবহার করতে পারা মেধাবীদেরই কাজ অবশ্য। এখন ধরেন ‘নগদ’ যেমন পোস্টাল অ্যাক্ট এর ধুয়া তুলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন পাশ কাটিয়ে গেছে তেমনি যদি ক্ষুদ্রঋণ এর আইন দেখিয়ে কোন বড় এনজিও বলে আমরাও ঋণ কার্যক্রমে ও লেনদেনে নিজেদের ডিজিটাল ওয়ালেট চালু করবো লাখ লাখ গ্রাহকের জন্য, আমরা এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের জুরিসডিকশন মানি না, এমআরএ যদি তাতে সমর্থন দেয়, অবস্থাটা কী হবে? অথবা সমবায় আইন দেখিয়ে আমরা যদি একটা সমবায় সমিতির নামে ডিজিটাল ওয়ালেট চালু করে বলি- সমবায় আইন অনুসারে আমরা বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও মাইক্রো লেন্ডিং করবো, এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন মানতে আমরা বাধ্য নই কারণ আমরা সমবায় আইনের অধীন, সমবায় অধিদপ্তরও এই কাজকে রাজনৈতিক চাপে প্রশ্রয় দেয় তাহলে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে নৈরাজ্য কই গিয়ে দাঁড়াবে? ডাক বিভাগ ও থার্ড ওয়েভ মিলেমিশে রেগুলেশন এভাবেই বাইপাস করেছে। বেশ চালাকির সাথে, রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলে যা সম্ভব ছিল না।
তারপর নগদ বাজারে অপারেশন বিস্তৃত করে ডাক বিভাগকে ব্যানারে রেখে আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গেছে, লাইসেন্সের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নিরুপায় অসহায় রেগুলেটর এখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতে। তারা ‘বিশেষ মহল’ এর চাপে ইন্টেরিম লাইসেন্স দিয়েছে, বেশ কিছু শর্ত দিয়ে নগদ কে বলেছে ভালো হয়ে যাও, কমপ্লাই কর, তাহলে পূর্ণ লাইসেন্স পাবে।
নগদ সেই শর্ত ও সময়সীমার কিছুই পূরণ করতে পারেনি। টিবিএস এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে,
Later in September 2021, the central bank extended the interim licence period of Nagad for a fifth time at the condition of adjusting loans taken against the public money by 30 September this year.
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘পই পই’ করে বলার পরও ৫ বারেও শর্তাবলী পূরণ করে পূর্ণ লাইসেন্স নিতে পারেনি নগদ। এতটাই তাদের কমপ্লায়েন্স দক্ষতা।
সো, প্রিয় গ্রাহক, আপনাদের অবগতির জন্য এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই- নগদ বাজারে ঢুকেছিল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, সব আইন ভেঙ্গে। এরপর তাকে দুই বছর যাবত সময় সুযোগ দেয়ার পরও সে ‘মাসুদ’ এর মত ভালো হতে পারেনি, পারছে না!
কিন্ত সুখন সাহেব বলছেন যে তারা জনগণের মহান কল্যাণ করতে এসেছেন, সস্তায় মানি ট্রান্সফার করতে দিয়ে।
যারা আর্থিক খাতে কোন আইন কানুন তোয়াক্কা না করে শুরু করেছে, এখনো লাইসেন্স এর কমপ্লায়েন্স পূরণ করতে পারে নাই, তাদের দ্বারা কী হতে পারে তা আমরা এর আগে গত এক দশকে বেশ কিছু ঘটনায় দেখেছি, যেমন বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ই-ভ্যালী ইত্যাদি! বাকিটা আপনাদের বিবেচনা, সময়ের সাথে অদূর ভবিষ্যতে সব স্পষ্ট হবে।
জনাব সুখন তার ভিডিওতে দাবি করেছেন যে ডাক মন্ত্রী যেহেতু বলেছেন নগদ ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেন, তাই সন্দেহের অবকাশ নাই যে তা ডাক বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট।
এখন আমি কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই, যার উত্তর নগদ এর সিনিয়র লিডারশিপ টিমের সাথে ২০১৯ সালে ঢাকায় জাতিসংঘে কর্মরত অবস্থায় একটি বৈঠকে তুলেছিলামঃ
– নগদ তুমি কার? ডাক বিভাগের, নাকি থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস এর?
এই প্রশ্নটি নানা আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ। টিবিএস এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে আমরা যা জেনেছিঃ
To get a full license, the Bangladesh Post Office has to form a company to run Nagad as its subsidiary. Despite being given five extensions, the last of which is to end on 30 September, Nagad could still not become a subsidiary of Bangladesh Post Office.
Under this situation, since Nagad as an MFS cannot operate alone, it has applied to the Bangladesh Bank to operate as a non-bank financial institution under which it will work as a subsidiary to legalise its operation.
Commenting on the situation, Mustafa Jabbar, minister for Posts and Telecommunications, told The Business Standard on Wednesday, “Bangladesh Post Office does not own Nagad and is not going to take any stake in it.” Now the Post Office does not want to own Nagad with which it shares 51% revenue.
He said Bangladesh Post Office does not operate Nagad, it has no ownership in it and no post office employees work with Nagad.
Explaining the relation with Nagad, he said the company only shares revenue with the Bangladesh Post office.
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পোস্ট অফিস নগদ এর মালিকানায় নেই, অপারেশন্সে নেই, শুধু রেভিনিউ শেয়ারিং এ আছে।
এইখানে একটা বড় ফাঁক আছে- রেভিনিউ শেয়ারিং এ আছি, লস হলে তার দায়ভার কাদের?
থার্ড ওয়েভ লিমিটেড যদি ব্যাংক থেকে বড় লোন নিয়ে লস করে, এরপর দেউলিয়া হয়ে যায় (হতেই পারে, এমএফএস ব্যবসায় এত বছর পর এসেও বিকাশ বাজারে এত আধিপত্য নিয়েও ২০২১ সালে ১২৩ কোটি টাকা লস করেছে, তথ্যসূত্রঃ দ্যা ডেইলি স্টার, ৫ এপ্রিল ২০২২),
তাহলে গ্রাহকের ওয়ালেটে যে ই-মানি থাকবে, সেই টাকার দায় মেটাবে কারা?
ডাক বিভাগ রেভিনিউ শেয়ারিং এ আছে, বিজনেস মডেল ফেইল করলে দায় কি তারা নেবে? মানে আপনার ট্যাক্সের পাবলিক মানি দিয়ে সেই ঘাটতি ভরা হবে?
যেমনটা বেসিক ব্যাংকে, পদ্মা ব্যাংকে হচ্ছে?
এইখানে আরেকটা মাঝারি ফাঁক, যার উত্তর আমরা জানি না, ‘নগদ’ ব্র্যান্ড এর অধিকার কার? বিকাশ, রকেট ইত্যাদি নামের যেমন বাজারমূল্য তথা ব্র্যান্ড ভ্যালু রয়েছে, তেমনি ডাক বিভাগের নামের সাথে ‘নগদ’ ব্র্যান্ডটিরও (ইতিবাচক বা নেতিবাচক) বাজারমূল্য তৈরি হচ্ছে। ডাক বিভাগের সাথে থার্ড ওয়েভ এর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ও সেই চুক্তি যদি নবায়ন না হয় এবং অন্য কোন অপারেটর এই কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পায় সেক্ষেত্রে ‘নগদ’ ব্র্যান্ড এর নামটি কার স্বত্ব?
এর মধ্যে আবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছে।
২০২২ এর শুরুর দিকে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নাম বদলে ‘নগদ লিমিটেড’ হয়ে গেছে রেজিস্ট্রেশনে!
নাম বদলে ফেলার নানা মোটিভ আছে। সেগুলোও অদূর ভবিষ্যতে উন্মোচিত হবে!
আর আরেকটি ছোট ফাঁক-
নগদ এর কার্যক্রমে যে বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের সনাক্তকরণ ও লেনদেন এর ডেটা সঞ্চালিত হচ্ছে তার সুরক্ষা ও শেষমেশ সংরক্ষণ এর অধিকার ও দায় কার? যেহেতু ডাক বিভাগ নগদ ওউন করে না, আবার নগদ লিমিটেড বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বারা পূর্ণ লাইসেন্স প্রাপ্ত কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠানও নয় এখন পর্যন্ত, গ্রাহকের ডেটা সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোন গ্যাঞ্জাম হলে কাকে রেগুলেটর দায়ী করবে?
প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর অজানা!
যাক, এখন জনাব সুখন যে সিআইবি রিপোর্টের স্ক্রিনশট দেখিয়ে টোটাল আউটস্ট্যান্ডিং এমাউন্ট শূন্য নিশ্চিত করে আমাদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, সেই ফাঁকটা নিয়ে আলাপ করে শেষ করি!
এক্সিম ব্যাংক মার্চ ২০২২ এ বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টকে চিঠি দিয়ে জানায় থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস এর ৩৬৪ কোটি টাকা মূল্যমানের ২২ টি হিসাবের বিপরীতে ৩১৭.৬০ কোটি টাকার মেয়াদ উত্তীর্ণ দেনা সমন্বয় করা হয়েছে।
এইখানে লেগেছে গ্যাঞ্জাম।
এর মধ্যে চিঠিতে আরেকটা দুর্দান্ত বাটপারির প্রচেষ্টার কথা আছে, যা এক্সিম ব্যাংক হতে দেয়নি। তা হল তারা তাদের হিসাবের নাম পরিবর্তন করে ‘Nagad Ltd., Trust cum Settlement Account (TCSA)’ করার জন্য এক্সিম ব্যাংককে বারবার তাগাদা দিচ্ছিল।
কোম্পানির নাম বদলে ফেলা, এরপর যে দেনা দুই বছরে পরিশোধ করছে না তার বিপরীতে থাকা স্থিতি হিসাবের একাউন্টের নাম বদলে ফেলার চেষ্টার মধ্যে একটা কারসাজি আছে।
যদি এক্সিম ব্যাংক হিসাবের নাম পরিবর্তন করে ‘Nagad Ltd., Trust cum Settlement Account (TCSA)’ করার অনুমতি দিত, তাহলে সম্ভবত নগদ এর মেয়াদোত্তীর্ণ দেনা ওই Trust cum Settlement Account থেকে এক্সিম ব্যাংক আর সমন্বয় করতে পারত না। কারণ পিএসডি সার্কুলার ০৬/২০২১ অনুযায়ী Trust cum Settlement Account ব্যবহার করে কোন লোন নেয়া কিংবা সমন্বয় করা নিষেধ। দুর্দান্ত বুদ্ধিমান নগদ এর ব্যবস্থাপকগণ এই সুযোগটা নিয়ে ওই ঘাটতি ও মেয়াদোত্তীর্ণ দেনা শোধটা ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সফল হননি!
এখন, কেন সিআইবি তে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস এর দায়দেনা শূন্য দেখাচ্ছে?
কারণ এক্সিম ব্যাংক তো তার দেনা সমন্বয় করে নিয়েছে। ফলে এক্সিম ব্যাংকের কাছে নগদ এর মেয়াদোত্তীর্ণ কোন দেনা নাই।
ফলে সিআইবি রিপোর্ট ফকফকা!
কিন্ত বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া চিঠিতে এক্সিম ব্যাংক বলছে, এই ঘাটতি নগদ পূরণ করেছে গ্রাহকের কাছে ছাড়কৃত ই-মানির সমপরিমাণ টাকা যে Trust cum Settlement Account থেকে। ফলে সেখানে ৩১৭ কোটি টাকার ঘাটতি আছে।
Trust cum Settlement Account এ ঘাটতি সিআইবি রিপোর্টে আসে না। সেটা পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট এর কাছে এমএফএস অপারেটর প্রেরিত রিপোর্টে ধরা পড়তে পারে (যদি অপারেটর ঠিকঠাক রিপোর্ট করে)। এখন নগদ এর রিপোর্ট ঠিকঠাক আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে কতদূর ইন্সপেকশন বা যাচাই বাছাই করে, কিংবা কিছু ধরা পড়লেও বাইরে বলতে পারে কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ! ক্ষমতার জোরে রেগুলেটর এর মুখ বন্ধ!
এইখানে জনাব সুখন আরেকটা ফাঁকি দিয়েছেন জনতাকে তার ভিডিও বক্তব্যে।
Trust cum Settlement Account দেখিয়ে লোন নেয়া যাবে না এই সার্কুলার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসেছে ২০২১ এর মে মাসে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে নগদ লোন নিয়েছিল নাকি তার আগে ২০১৯ থেকে, তখন এই নীতিমালাই তো ছিল না।
মূল ঘটনা হল, এর আগে কোন এমএফএস অপারেটর Trust cum Settlement Account দেখিয়ে বড় লোন নেয়ার ঘটনা ঘটায়নি (কারণ বিকাশ কিংবা রকেট ইত্যাদির বিনিয়োগ করার শক্তিশালী পকেট ছিল)। নগদ এখানে বাজারে ইউনিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, মানুষের টাকা পকেটে নিয়ে সেই তেলে মাছ ভাজার। এরপর রেগুলেটর নড়েচড়ে বসে একে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গাইডলাইন জারি করে। নিঃসন্দেহে এই ইনোভেশনে বাজারে নগদ ব্যতিক্রমী! সুখন সাহেব এই নীতিমালা জারির পেছনে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ অবদানের কথা চেপে গেছেন!
যাক, এখন আবার টিবিএস এর রিপোর্ট পড়েনঃ
After encashment of the due loan amount by Exim Bank, Nagad on 5 April requested Bangladesh Bank to take action against Exim Bank, terming the loan adjustment unlawful and demanded justice.
In response to that, the Bangladesh Bank, in a letter to Nagad on 16 May, said that taking loan against public money by Third Wave Technologies was a clear violation of the central bank rule. Nagad was informed about the violation and was instructed to take necessary steps but they did not follow the instructions.
হাহা, আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সট্রাকশন না মানার নজির!
এই নিয়ে এক্সিম ব্যাংকের ব্যাপারে আবার নালিশও করেছে নগদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, যে এই দেনা সমন্বয় ঠিক হয়নি! তাদের অপরিশোধিত দেনা অনন্তকাল চালিয়ে যেতে দেয়া উচিত ছিল!
এখনঃ
As the loan created a deficit in the trust fund of Nagad, the Bangladesh Bank asked the post office to adjust the loan by September this year to meet up the shortfall of public money.
In a letter to the Bangladesh Post Office, the central bank said that Third Wave Technologies has taken loans using public money as security resulting in a shortfall in real money than e-money which is a clear violation of Bangladesh Mobile Financial Services (MFS) Regulations, 2018.Despite the risky operation of Nagad, the central bank extended the interim licence period considering their request and at the interest of customers, the letter said.However, the condition of the licence is that the Bangladesh Post Office has to adjust the loan within one year or owners of the entity will deposit their own money to meet up the shortfall of public money.Bangladesh Post Office will be solely responsible for meeting the shortfall until Third Wave Technologies free from lien the deposit amount given as security to the Exim Bank, according to the letter.Now the Post Office is under the burden of making up the shortfall of Tk317.60 crore, as the Bangladesh Bank has all along held the Post Office responsible for all liabilities of Nagad because the MFS licence was issued in the name of the Post Office.
এগুলো লাইক লাভ কামানো আমাদের মত সোশ্যাল মিডিয়ার লেখালেখি করা লোকজনের আলাপ না, যেমনটা সুখন ভাই বলেছেন। এগুলো রেগুলেটরদের, সরকারি সংস্থার চিঠি চালাচালির বক্তব্য!
সো ফকফকা সিআইবি রিপোর্ট দেখিয়ে, মান্থলি ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়ে এইসব বাকোয়াজ আলাপ করে বিশেষ সুবিধা হবে না। অন্যদের কাছে কাগজ না চেয়ে রেগুলেটরের কাছে কমপ্লায়েন্ট হউন, আর আমাদের দেখান যে নগদ এর পরিচালন মুনাফা কত, নিট মুনাফা কত গত এক দুই বছরে, আপনার বিজনেস মডেলে কীভাবে যে পরিমাণ লোন গ্রাহকের টাকা দেখিয়ে তুলেছেন ও তার দেনাই শোধ করতে পারেন নাই, তা কীভাবে ব্যবসায় প্রফিট করে শোধ করবেন ভবিষ্যতে! কীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত পূরণ করে পূর্ণ লাইসেন্স পাবেন, বৈধ হবেন বাজারে!
আমার অনুমান (আর্থিক খাতের ফ্রডদের ব্যাপারে আমার অনুমান শক্তি বেশ ভালো) এক পর্যায়ে গিয়ে ইভ্যালীর মতই নগদ এরও একটা বিশদ অডিট হবে, তা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যখন রাজনৈতিক চাপ উপর থেকে আলগা হয়ে আসবে।
টাকা মেরে মূল কুশীলবরা ভেগে যাওয়ার এক পর্যায়ে সব প্রভাব ক্ষীয়মান হয়, তখন রেগুলেটর সক্রিয় হয়!
এরপর নানা রহস্য ‘পই পই’ করে বের হবে।
আরেকটা ব্যাপার, জনাব সুখন একটা কথা সত্য বলেছেন। নগদ আপনাদেরই, দেশের উদ্যোগ।
তা যদি দেউলিয়া হয় তখন ডাক বিভাগ আপনাদেরই ট্যাক্সের টাকা থেকে তা ভরে দেবে। যেমনটা বেসিক ব্যাংক কিংবা পদ্মা ব্যাংকে হয়েছে।
সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন!
লেখক: গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম
আপনার মতামত জানানঃ