নগদ বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং খাতে এক সময়ের নির্ভরযোগ্য নাম হলেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটি চরম অস্থিরতা ও অনিয়মের মধ্যে পড়ে গেছে। একের পর এক অভ্যন্তরীণ সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির স্থিতিশীলতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সাধারণ গ্রাহক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করছে নগদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
প্রতিষ্ঠানটির এই সংকট অনেকাংশেই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সিন্ডিকেটভিত্তিক দখলদারিত্বের ফলাফল। একদিকে সরকার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্রুপ ও উপগ্রুপ নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কিছু ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। এই দ্বন্দ্বের ফলেই নগদের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং কর্মীদের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
নগদের অভ্যন্তরে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানটির স্বার্থ রক্ষার চেয়ে নিজের প্রভাব বিস্তারে বেশি আগ্রহী বলে অভিযোগ উঠেছে। ডাক বিভাগের একটি অংশ নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে তৎপর, অন্যদিকে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠরা নিয়মিতভাবে নগদের নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দৈনন্দিন কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
নগদের সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। গত বছরের আগস্ট মাসে তিনি বিদেশে চলে যান, তবে তার বিদেশে অবস্থান করলেও তিনি ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এখনো প্রতিষ্ঠানটির ওপর প্রভাব খাটাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, তানভীর এ মিশুক তার অনুসারীদের দিয়ে ভুয়া বিল তৈরির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ডাটাবেইজ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলা, অতীতের ইভেন্ট দেখিয়ে বিল উত্তোলন, মেইনটেন্যান্স খাতে বকেয়া দেখিয়ে অর্থ তুলে নেওয়া—এসবই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।
ডেপুটি সিইও মুয়ীজ নাসনিম ত্বকীর ঘটনাও নগদের দুরবস্থার একটি বড় দৃষ্টান্ত। বেইলি রোডের নিজ বাসা থেকে আটক হলেও বিশেষ রাজনৈতিক সহায়তায় পরদিনই মুক্তি পান তিনি। এই ঘটনার পর তিনি আরও নির্ভীক হয়ে উঠেছেন এবং ভুয়া বিল তৈরিতে কর্মীদের বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার এমন আচরণে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম-নীতি ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
নগদের অফিসে নিয়মিত বসে থাকা অথচ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে না থাকা আতিক মোর্শেদের উপস্থিতি ও প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি একজন বিশেষ সহকারীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত হলেও, নগদের অফিসে সিইও’র চেয়ারে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। নিজের স্ত্রী ও আত্মীয়দের নগদে নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত করার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
এদিকে, নতুন সিইও মো. সাফায়েত আলম নিয়োগের পর থেকেই বিদেশে অবস্থান করছেন এবং এখনো অফিসে যোগ দেননি। তিনি ভার্চুয়ালি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু এতে কার্যকারিতা না থাকার অভিযোগ করছেন নগদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ১৯ জন শীর্ষ কর্মকর্তা বরখাস্ত, তানভীরের অনুসারীদের পদোন্নতি ও বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগকে আরও শক্তিশালী করেছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, নগদের আইটি বিভাগের মাধ্যমে পুরনো ডাটাবেইজ ধ্বংস করা এবং পেছনের তারিখ দিয়ে ভুয়া ইভেন্টের নামে বিল উত্তোলন। এর ফলে অডিট বা ভবিষ্যৎ তদন্ত জটিল হয়ে পড়বে এবং প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি অর্থ সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ ইঙ্গিত বহন করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থানও এই সংকটে জর্জরিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, আদালতের এক আদেশকে কাজে লাগিয়ে নগদ কর্তৃপক্ষ প্রশাসকদের সরিয়ে দিয়েছে। যদিও তারা আপিল করেছেন, তবে সেটির শুনানি এখনো হয়নি। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে নগদে ব্যাপক অনিয়ম চলছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক জানলেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারছে না।
এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট যে, নগদ এখন একটি চরম নৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটে নিপতিত। মোবাইল ব্যাংকিং খাতে এ প্রতিষ্ঠানের এমন দুর্দশা শুধু প্রতিষ্ঠানটির নয়, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি। কারণ, নগদের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন লেনদেন করে। এই সেবার ওপর গ্রাহকদের নির্ভরতা এতটাই যে এর অভ্যন্তরীণ সংকট সাধারণ মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা প্রয়োজন। সর্বপ্রথম, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নগদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ অডিটের মাধ্যমে সব অনিয়মের তদন্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানটি থেকে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করে পেশাদার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, দুর্নীতিতে জড়িত সকল ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের সাহস না পায়।
সবশেষে বলা যায়, নগদের এই সংকট বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং খাতের একটি কঠিন শিক্ষা। সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে নগদকে আবার স্থিতিশীল ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাই এখন সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানানঃ