গত দেড় দশকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে অনেক নজিরবিহীন ঘটনাই ঘটেছে। এর মধ্যে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদানের নামে ‘নগদ’–এর উদ্ভব ও বিস্তারের প্রক্রিয়াটি বৈশিষ্ট্যগতভাবে ভিন্ন, যা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ব্যাংক খাতে ঋণ কেলেঙ্কারিগুলো ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ব্যাংকগুলোয় প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। অন্যদিকে নগদের উত্থান ঘটেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই, মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদানের বিদ্যমান নিয়মনীতিকে ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে।
সম্প্রতি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে নগদের জন্য প্রশাসক নিয়োগ ও বিশদ নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালের শেষভাগে যাত্রা শুরুর সময় থেকেই নগদের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন কূটকৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান ও তদারকির এখতিয়ারকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। সেই প্রেক্ষাপট এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) তথা মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবাগুলো বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের বাজারে যাত্রা শুরু করে ২০০৭-০৮ সালের দিকে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে টেলিকম অপারেটরদের আর্থিক সেবা প্রদানের লাইসেন্স দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বেছে নিয়েছিল ‘ব্যাংক লেড মডেল’। যেখানে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে শর্ত ছিল, একটি ব্যাংকের নেতৃত্বে ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ও পরিচালনা বোর্ডে ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সাবসিডিয়ারি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। বিকাশ, রকেট, উপায় ইত্যাদি সুপরিচিত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস এই বিধানের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পেয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
নগদের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিসের সঙ্গে কোনো অনুমোদিত ব্যাংক ৫১ শতাংশ মালিকানা নিয়ে যুক্ত হয়নি। জাতীয় পর্যায়ে তাদের কোনো আর্থিক সেবা পরিচালনার অভিজ্ঞতাও ছিল না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য অনুপযুক্ত হওয়ায় তারা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস রেগুলেশনস ২০১৮–কে পাশ কাটিয়ে ডাক বিভাগের ওপর সওয়ার হয়েছিল মূলত ডাক বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক আনুকূল্যকে অবলম্বন করে।
ডাক বিভাগ ব্রিটিশ আমল থেকেই জনগণকে অর্থ আদান–প্রদানের সেবা দিয়ে আসছে। পোস্ট অফিস অ্যাক্ট ১৮৯৮ সংশোধন করে ২০১০ সালে সংসদে দ্য পোস্ট অফিস (সংশোধন) আইন, ২০১০ অনুমোদিত হয়। নগদ, তথা থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিসের উদ্যোক্তারা মূলত এই বিধিমালার শরণাপন্ন হয়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ডাক বিভাগের ব্যানার ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস–সংক্রান্ত বিধানগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেশনস ২০১৪ অনুসারে সব ধরনের (ডিজিটালসহ) আর্থিক লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ ও বিধান প্রণয়নের এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। রাষ্ট্রীয় অন্য সব প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি মানতে বাধ্য। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে ছবি প্রকাশিত হয়, অথচ মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা পরিচালনার জন্য তখনো নগদের বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত কোনো লাইসেন্স ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স ছাড়াই একটি নতুন আর্থিক সেবার প্রচার ও প্রসারে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যখন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেন, তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না!
নগদের উদ্যোক্তাদের শুরুতে অজুহাত ছিল যে তাঁরা ডাক বিভাগের আর্থিক সেবা পরিচালনা করছেন, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রচিত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস রেগুলেশনস অনুসরণ তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান পাশ কাটিয়ে ডিজিটাল লেনদেন চালু করার ক্ষেত্রে যে নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা ছিল আর্থিক খাতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস পরিচালনায় গ্রাহকের যে পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে, তার বিপরীতে তারা কী পরিমাণ ইলেকট্রনিক মানি তৈরি ও সঞ্চালন করেছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।
আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হলো, শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ক্রমাগত নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে নগদের উদ্যোক্তারা আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ফিরে গেছেন লাইসেন্সের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন লাইসেন্স দিয়ে নানা শর্ত পূরণের জন্য সময় দিয়েছিল একাধিকবার, যেটা তারা পূরণ করতে পারেনি বা ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি। কিন্তু যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই ‘সরকারি সেবার’ নামে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দেশব্যাপী তাদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়েছে। এর মধ্যেই ডাক মন্ত্রণালয় ও ডাক বিভাগের অজান্তেই ‘থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস’ থেকে নাম পরিবর্তন করে তারা হয়ে যায় ‘নগদ লিমিটেড’। ডাক বিভাগের সঙ্গে তাদের চুক্তি ও মুনাফা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, নগদের মালিকানায় আসলে কারা আছেন ইত্যাদি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা প্রতিবেদনে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, যার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন থেকে আমরা জেনেছি, তারা মোবাইল ওয়ালেটে জমাকৃত অর্থ জামানত হিসেবে দেখিয়ে ব্যাংকের ঋণ নিয়েছেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী নিষিদ্ধ। মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রাহকের আমানতকে জামানত রেখে ঋণ গ্রহণ বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এরূপ অন্যায় করা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সরকারি উপবৃত্তি ও অন্যান্য প্রকল্পের অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে এককভাবে নগদের মাধ্যমে বিতরণের পক্ষপাতমূলক নীতিমালা প্রণয়নের পেছনেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যার যথাযথ তদন্ত ও সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাজারে গ্রাহকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেনি যে নগদ তাদের নীতিমালা মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণেও স্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।
এসব অভিযোগ থাকার পরও ২০২৩ সালের এপ্রিলে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স পায় নগদ, ‘নগদ ফিন্যান্স পিএলসি’ নামে প্রতিষ্ঠানটিকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তার আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) রেগুলেশনস সংশোধিত হয়, যেখানে ব্যাংকের পাশাপাশি নন–ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫১ শতাংশ মালিকানার ভিত্তিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সাবসিডিয়ারি গঠন ও পরিচালনার সুযোগ রাখা হয়। আর্থিক খাত–সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই সংশোধন করা হয়েছিল মূলত নগদকে লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ তৈরির জন্যই, যা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস রেগুলেশনস ২০১৮ অনুযায়ী সম্ভব ছিল না।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডিজিটাল ব্যাংক’–এর লাইসেন্স প্রদানের উদ্যোগ নিলে সেখানেও তারা পায় বিশেষ ছাড়, প্রথম আলোর গত ৩ জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী—‘ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৪ক(১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা পরিবারের সদস্যরা একক, যৌথ বা উভয় নামে কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনতে পারবেন না। তবে নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের শেয়ারের ক্ষেত্রে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ওই ধারা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নগদ ডিজিটাল ব্যাংকে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারধারী রয়েছে। অপর এক প্রজ্ঞাপনে আইনের ১৪ক(১) ধারার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১২১ ধারার ক্ষমতাবলে ব্লু হেভেন ভেঞ্চারস এলএলসি, আরসিসি ক্যাপিটাল পার্টনারস এলএলসি ও ফিনক্লুশন ভেঞ্চারস পিটিই লিমিটেড কর্তৃক “নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি”র শেয়ার ধারণের ক্ষেত্রে ১৪ক(১) ধারা প্রযোজ্য হবে না। অবশ্য কোন প্রতিষ্ঠান কত শতাংশ শেয়ার নিয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়নি প্রজ্ঞাপনে।’
নগদ পরিচালনায় কী দুর্নীতি হয়েছে, টাকা পাচার ও অন্যান্য কার্যক্রমে এর উদ্যোক্তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এখনো আমাদের অজানা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দলের অনুসন্ধান এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির মাত্রা আমাদের সামনে তুলে ধরবে বলে আশা করি।
আর্থিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহক পরিচয়ের সত্যতা নিরূপণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিএফআইইউর সার্কুলার ২৫ অনুযায়ী এমএফএসের ক্ষেত্রে গ্রাহক নিবন্ধনের (ই-কেওয়াইসি) ক্ষেত্রে পাঁচটি নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে হয়, যার মধ্যে ফেশিয়াল ম্যাচিং ও জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। এখানে প্রশ্ন থাকে, নগদ কীভাবে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের কাছ থেকে পাওয়া সীমিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে *১৬৭# ডায়ালের মাধ্যমে গ্রাহক নিবন্ধন করেছে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার কোনো লঙ্ঘন হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
নগদ পরিচালনায় কী দুর্নীতি হয়েছে, টাকা পাচার ও অন্যান্য কার্যক্রমে এর উদ্যোক্তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এখনো আমাদের অজানা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দলের অনুসন্ধান এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির মাত্রা আমাদের সামনে তুলে ধরবে বলে আশা করি। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে পরিচালিত হবে, তার নতুন রূপরেখাও তৈরি করতে হবে, যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে। সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ