স্কুলে যাওয়ার সময়ে হামলাকারীরা ঘিরে ধরেন ৩২ বছর বয়সী দলিত শিক্ষিকা অনিতা রেগরকে। মারধর করা হয় তাকে। পালিয়ে একটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে আশ্রয় নিলে সেখানেও হামলাকারীরা পৌঁছে যায়। অনেক মানুষের সামনেই তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয় তাকে।
পুলিশ বলছে, মূল অভিযুক্তরা ওই শিক্ষিকা অনিতা রেগরেরই আত্মীয় এবং তার মতো হামলাকারীদের অনেকেই দলিত শ্রেণীরই মানুষ। ধার দেয়া টাকা চাইতে গেলে ৩২-বছর বয়সী ওই শিক্ষিকাকে আক্রমণ করা হয়, তারপরে পেট্রোল ঢেলে তার দেহে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরে মারা যান ওই নারী।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন ওই শিক্ষিকা একটি ভিডিও বয়ান রেকর্ড করেন, যেটি তার মৃত্যুর পরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সেখানে তিনি জানান, “১০ই অগাস্ট সকালে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথেই আমার ওপরে হামলা হয়। আমি পালিয়ে একটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে আশ্রয় নিই। কিন্তু সেখানেও পৌঁছে যায় আক্রমণকারীরা। গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়ার পরেই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”
মিসেস রেগর পুলিশকে ফোনও করেছিলেন, কিন্তু তার অভিযোগ পুলিশ সময়মত পৌঁছয় নি। পরে তার স্বামী তারাচাঁদ খবর পেয়ে ছুটে এসে ৭০% দগ্ধ স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু শেষমেশ বাঁচানো যায় নি তাকে।
যে নির্মীয়মাণ বাড়িতে রেগর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে হামলার সময়ে আরও অনেকে জড়ো হয়েছিলেন, কিন্তু তার গায়ে যখন পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানো হচ্ছে, তখন কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নি।
দ্বিতীয় এক ভাইরাল ভিডিওতে এটাও দেখা গেছে যে জ্বলন্ত মিসেস রেগরের ভিডিও করছেন কিছু মানুষ, কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেন নি তাকে বাঁচাতে।
পুলিশ বলছে, হামলাকারীদের নামে আগেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন মিসেস রেগর, তার ভিত্তিতে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিন্তু যারা গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, তারা এখনও ফেরার।
জয়পুর গ্রামীণের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট ধর্মেন্দ্র যাদব সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, “ওই নারী তার এক আত্মীয়কে কিছু টাকা ধার দিয়েছিলেন যদিও তার কোনও নথিপত্র ছিল না। সেই টাকা শোধ করা নিয়েই একই পরিবারের মধ্যেই ঝামেলা হয় আগে।”
“নিহত নারী অভিযোগ করেছিলেন যে তাকে মারধর করা হয়েছে। সেসময়ে দু’জন নারীকে গ্রেপ্তারও করি আমরা। তার চারদিন পরে দ্বিতীয় একটি অভিযোগ আনেন মিসেস রেগর, তার ভিত্তিতে আরও দু’জন গ্রেপ্তার হন।
এরপরে দু’পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ দায়ের করে। সেই ঘটনার তদন্ত চলছিলই। তারমধ্যেই ১০ই অগাস্ট এই ঘটনা ঘটে যায়।
ভিকটিমের বয়ানের ভিত্তিতে কয়েকজন নারীসহ তার স্বজনদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
এই ঘটনায় অশোক গেহলটের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারকে নিশানা করে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সতীশ পুনিয়া বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি দাবি করে বলেন, ‘কংগ্রেস শাসন আমলে এ ধরনের ঘটনা প্রথম নয়। রাজ্যে এরকম অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। রাজ্যে প্রতিদিন গড়ে ১৮টি ধর্ষণ ও সাতটি খুনের ঘটনা ঘটছে।’
সতীশ পুনিয়া আরও বলেন, ‘অপরাধীদের কোনো ভয় নেই। কারণ, তারা জানে যে তাদের কিছুই হবে না। সাধারণ ধারায় মামলা দায়ের করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।’
উল্লেখ্য, ভারতে গত বছর প্রতিদিন গড়ে ১০ জন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে সরকারি তথ্যেই দেখা গেছে।
উত্তর প্রদেশে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে; মেয়েদের উপর যৌন নিপীড়নের সংখ্যাও এ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে ভারতে দলিতদের উপর যে পরিমাণ নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, তার অর্ধেকের বেশিই দেখা যায় উত্তর প্রদেশ, বিহার ও রাজস্থানে। ২০০৬ সালে ভারতের চার রাজ্যের ৫০০ দলিত নারীর উপর চালানো এক জরিপে তাদের উপর হওয়া নানা ধরনের নির্যাতনের তথ্য উঠে আসে।
জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ৪৬ শতাংশ যৌন হয়রানি, ৪৩ শতাংশ নিজেদের ঘরে সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা জানান। ২৩ শতাংশ জানান তারা ধর্ষিত হয়েছেন; গালাগালির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন ৬২ শতাংশ নারী।
কেবল অন্যদের হাতে নয়, দলিত নারীরা এমনকি তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতেও নিয়মিতই নির্যাতিত হয়ে আসছেন।
দলিতদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দলিত রাইটস গ্রুপ দলিত নারী ও মেয়েদের উপর ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ১৬ জেলায় হওয়া ১০০ যৌন সহিংসতার ঘটনা যাচাই বাছাই করে দেখেছে। তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে ৮৫ শতাংশ নির্যাতিত নারীর বয়স ৩০ এর নিচে; এর মধ্যে ৪৬ শতাংশের বয়স ১৮-র নিচে।
দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য বিশেষ করে নারীরা এখন তাদের উপর নির্যাতন নিয়ে সরব হওয়ার কারণে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন বলেও অনেকের ধারণা।
উল্লেখ্য, দলিতদের উপর বর্বর নির্যাতন ও নৃশংসতা বন্ধে ১৯৮৯ সালে একটি আইন করা ছাড়া ভারতের কোনো সরকারই দলিত নারীদের সহিংসতার হাত থেকে বাঁচাতে কোনো ধরনের পদক্ষেপই নেয়নি। এখনও এ নারীদেরকে লাঞ্ছনা, শারীরিক নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যায় সহজেই দায়মুক্তি মেলে।
এসডব্লিউ/এপসএস/১৫০৪
আপনার মতামত জানানঃ