চা শ্রমিকদের চলমান মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। তবে এর মধ্যেও নানা ফাঁকফোকর আছে। দেশে আর কোনো খাতেই এত নিম্ন মজুরি দেখা যায় না। অথচ চা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই একটি বড় শিল্প। চা খাতের মালিকরা কেউ ক্ষতির মধ্যে আছে বলে জানা যায় না। চা বাগানের ম্যানেজাররাও থাকেন আলীশান বন্দোবস্তের ভেতরে। তবু কেন চা শ্রমিকদের এভাবে দাসোচিত জীবনে বন্দি রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের এত কম মজুরি দিয়ে কারা মুনাফা লুটছে? এই অর্থে কীভাবে চলছে শ্রমিকদের?
চা বাগানের মালিক কারা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ভুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী দেশে চা বাগান আছে মোট ১৬৭টি। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২৩টি, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৯টি এবং সিলেটের বিভিন্ন জেলায় আছে ১৩৫টি। এসব চা বাগানের মধ্যে ৫টির মালিক সরকার নিজে। বাকি ১৬২টি ব্যক্তি মালিকদের দ্বারা পরিচালিত। এই মালিকদের মধ্যে দেশের স্বনামধন্য সব প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আলোচিত এনজিও ব্র্যাক, ট্রান্সকম গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, আহমেদ গ্রুপ, এইচআরসি গ্রুপ, হামদর্দ, জেমকন, প্রভৃতি কোম্পানি চা বাগানের মালিক। এছাড়া ফিনলে, ইস্পাহানি, ডানকানের মতো গ্রুপগুলো তো আছেই।
ডানকান, ফিনলে ছাড়াও বেশ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মালিক ইউরোপীয়। এছাড়া ভারতীয় মালিকদের তত্ত্বাবধানেও কয়েকটি চা বাগান রয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশি মালিকদের মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি সরাসরি মিডিয়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যেমন, ট্রান্সকম গ্রুপ দৈনিক প্রথম আলো ও দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকার মালিকপক্ষ। স্কয়ার গ্রুপ মাছরাঙা টিভির মালিক। ওরিয়ন গ্রুপ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার মালিক। এর বাইরে সিটি গ্রুপ ছাড়াও আরো কয়েকটি চা বাগান কোম্পানি মালিকের মিডিয়া ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে। এরা সকলেই অধিক মুনাফা নিশ্চিত করার নিমিত্তে চা বাগান শ্রমিকদের নিম্ন মজুরিতে আটকে রেখেছে। যদিও বাংলাদেশের সমাজে এসব কোম্পানির মালিকদের অনেকে সজ্জন, নীতিবান, ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত।
ব্র্যাকের মালিকানায় রয়েছে ব্র্যাক কোদালা টি কোম্পানি লিমিটেড। এটি চট্টগ্রামে ৩টি চা বাগান পরিচালনা করছে। কোদালা চা বাগানটি রাঙ্গুনিয়ায় ১০০৬ হেক্টরেরও বেশি জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এটির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন সাইদ বখত মজুমদার এবং ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুল লতিফ। সাইদ বখত চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ব্র্যাকের আরো দুটি চা বাগানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটির নাম কৈয়াছড়া-ডলু চা বাগান। অন্যটির নাম কর্ণফুলী চা বাগান।
ট্রান্সকম গ্রুপের সাইফুর রহমানের মালিকানায় রয়েছে ৩টি চা বাগান। মণিপুর টি কোম্পানি লিমিটেডের নামে এবাগানগুলো পরিচালিত হয়। মৌলিভীবাজারের কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে এ বাগানগুলো অবস্থিত। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলের চা বাগানটি সাইফুর রহমানের নিজের নাম, সাইফ চা বাগান নামে নিবন্ধিত।
ওরিয়ন গ্রুপের সালমান ওবায়দুল করিম পরিচালনা করেন জাফলং চা বাগান। সিলেটের গোয়াইনঘাটে জাফলং এলাকায় অবস্থিত এই বাগানটি ৮৭৬ হেক্টর জমির উপরে অবস্থিত।
স্কয়ার গ্রুপের সামিউল এস চৌধুরীর মালিকানায় রয়েছে শাহবাজপুর টি কোম্পানি লিমিটেড। মৌলবীবাজারের বড়লেখায় তাদের মালিকানাধীন চা বাগানটির আয়তন ১১৬৮ একরের বেশি।
আকিজ গ্রুপের শেখ বশির উদ্দিনের মালিকানায় মৌলভীবাজারের বড়লেখায় রয়েছে বাহাদুরপুর চা বাগান। এটির আয়তন ৩৪৬ হেক্টরের বেশি। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন এবিম কাদের সিদ্দিকী।
এছাড়া আহমেদ গ্রুপের মালিকানায় সিলেট অঞ্চলে ৮টি চা বাগান রয়েছে। ফিনলে টি’র ৭টি, ডানকান ব্রাদার্সের ১৬টি, ন্যাশনাল টি’র ১২টি, ইস্পাহানী গ্রুপের ৪টি, এইচআরসি গ্রুপের ২টি এবং হামদর্দ, সিটি গ্রুপ ও টিকে গ্রুপের রয়েছে ৩টি করে চা বাগান।
শ্রমিকদের কেমন রেখেছে কোম্পানিগুলো
হবিগঞ্জের ৩৩ বছর বয়স্ক চা শ্রমিক সুমন মুন্ডা আমার সম্পাদিত ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক পত্রিকা “শতফুল”কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি মজুরি পান দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের বিপরীতে মাত্র ১২০ টাকা। তবে সেই টাকাও পুরোপুরি পান না। তিনি বলেন, ‘সাপ্তাহিক হিসেবে পেমেন্ট দেয়, আর সপ্তাহে পাই তিন কেজি চাল বা গমের রেশন। কিন্তু ১২০ টাকা পুরোপুরি হাতে আসে না। মাসে ২০০ টাকা হারে পেনশনের জন্য টাকা কাটে।’
এই টাকায় কিভাবে চলে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘সপ্তাহে যেদিন পেমেন্ট দেয় সেদিন হয়তো একটু মাছ-টাছ দিয়ে খাওয়া হয়। বাকি দিনগুলায় আছে চা পাতা আর আলু ভর্তা।’ সুমন মুন্ডা জানান, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই আমার পূর্ব পুরুষরা চা বাগানের শ্রমিক ছিল। আমার বাপ-দাদা চৌদ্দ সিঁড়ি থেকে এই কাজই করছে। আমরা তারপরও এই কাজই করতেছি। এটা চলমান ধারা। যতদিন চা বাগান থাকবে ততদিন এই কাজ থাকবে। রিটায়ার্ডের পর আমার ছেলে-মেয়ে পারমানেন্ট হবে। এইখানে আমরা লাইফ গ্যারেন্টি আবদ্ধ, শিকলে বাঁধা। হাতকড়া খোলার লোক নাই।’
চা শ্রমিকরা রাষ্ট্রের নাগরিক। যদিও তারা সংখ্যাগুরু জাতি বা ধর্মের সদস্য নয়। কেবল এ জন্যই কি তাদের হীন জীবনযাপনে বাধ্য করা হচ্ছে। রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, অধিকারবাদী নানা পক্ষ কি কেবল এ কারণেই নীরব।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে উক্তিটি সুমন করেন, তা হলো, ‘মায়ের পেটে থাকতেই কম্পানি বেঁধে ফেলছে।’ কীভাবে এটা সম্ভব, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘ম্যাটার্নিটির তিন মাস ছুটি দেয়। ওই তিন মাসের খরচ কম্পানি বহন করে। মনে করেন যে, আমার বউয়ের ম্যাটার্নিটি খরচ যখন কম্পানি বহন করছে, তখন যে সন্তানটা আসবে তার মালিকানা কম্পানিরই। কারণ ওই যে ম্যাটার্নিটির সময় বসায়া বসায়া পুরা হাজিরাটা দিচ্ছে। আর কিছু ওষুধ দেয়। কী ধরনের একটা ওষুধ দেয় যেন, ওটা ক্যালসিয়ামের। ভিটামিন দেয়, ওগুলো মহিলাদের জন্য। তারপর তিনমাস ম্যাটার্নিটি শেষ হয়ে গেলে আপনার বাচ্চা গেদাই থাকুক, সুস্থই থাকুক আর অসুস্থই থাকুক, অফিস থেকে এসে কাজে যাওয়ার অর্ডার দিয়ে যায়। বাড়িতে যদি আর কেউ নাও থাকে, বাচ্চা যতই কান্নাকাটি করুক, লাভ নাই। আপনি তো পারমানেন্ট লোক, আপনাকে চা বাগানে যাইতেই হবে।’
এরপর এই দাসত্বের ধারা চলমান থাকে। তার ভাষায়, ‘বাচ্চার বয়স পাঁচ-ছয় বছর হলে যদি আপনি ভর্তি করেন, তাইলে তারা স্কুলের খরচা ফ্রি করে দেয়। তারপর তার আঠারো বছর পূর্ণ হলেই কাজে নামতে হয়। আবার ছেলের বাবা রিটায়ার্ড হইলে বা মারা গেলে, তার পরিবর্তে ছেলেকে কাজে যোগ দিতে হবে।’
মালিকদের সম্বন্ধে জানতে চান প্রতিবেদক মোরশেদুল আজাদী। জবাবে চা শ্রমিক সুমন মুন্ডা বলেন, ‘যেহেতু তারা মালিকপক্ষ, শ্রমিকের পক্ষে তারা কমই কথা বলে। কিন্তু কর্মের দিক দিয়া তারা অনেক শাসন করে। বাগানে কোনো ঊনিশ-বিশ হইলে হাজিরা কাটা, কাজ বন্ধ। তারপর তিন-চারদিন বাড়িতে বসে থাকতে হয়। আবার অফিসে গিয়া মাফ চাইতে হয়। আমারে কাজটা দিবেন স্যার, এই বলে মিনতি করতে হয়। দয়া হইল তো কাজ দিল, নইলে এক মাস কাজ বন্ধ। তখন একবেলা খাইলে দুই বেলা নাই, এমন করেই দিন কাটাই। কম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে কিছু কাজ করা যায়, কিন্তু ধরা পড়লে তার শাস্তিও পাওয়া লাগে। তবু কঠিন সময়ে অনেকে নিয়ম কানুন মানে না। এইভাবেই চলে আরকি।’
দাসত্বের ফাঁদ কবে ভাঙবে
সুমন মুন্ডার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়কাল ২০১৯ সাল। এরপর করোনাভাইরাস মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে গোটা বিশ্ব। এই পরিস্থিতি চা শ্রমিকদের আরো ভয়াবহ সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। না খেয়ে জমানো সম্বলের বড় একটা অংশ শেষ হয়েছে ওই সময়টাতে। এখন চলছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কা। এ অবস্থায় সুমন মুন্ডারা বেশি কিছু নয় দাবি করেছেন দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা মাত্র। কিন্তু মালিকরা তা দিতে রাজী নয়। শ্রমিকদের ঠেকাতে অস্ত্র হাতে মাঠে নেমেছে পুলিশ।
এদিকে সরকারি সংস্থা নিজেও চা বাগান পরিচালনা করছে। চা শ্রমিকরা রাষ্ট্রের নাগরিক। যদিও তারা সংখ্যাগুরু জাতি বা ধর্মের সদস্য নয়। কেবল এ জন্যই কি তাদের হীন জীবনযাপনে বাধ্য করা হচ্ছে। রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, অধিকারবাদী নানা পক্ষ কি কেবল এ কারণেই নীরব। এর আগে ২০০৯ সালে চা শ্রমিকদের মজুরি ছিল দৈনিক ৪৮ টাকা। এরপর শ্রমিকদের দাবির মুখে আরেক ধাপ বেড়ে হয় ৬৯ টাকা। ২০১৬ সালে আবার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে হয় ১২০ টাকা। ইতিহাস বলে, রাষ্ট্র কখনোই চা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখেনি, বরং তাদের দাসোচিত জীবনে আটকে রেখে কোম্পানিগুলোকে মুনাফা লুটতে সাহায্য করেছে।
অনেকেই এটা শুনে অবাক হচ্ছেন যে, চা শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। কিন্তু কারা তাদের এই দাসোচিত মজুরি নিতে বাধ্য করছে? এই লেখার শুরুতেই দেখিয়েছি যে, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, মাছরাঙার মতো অনেক গণমাধ্যমের মালিকও রয়েছেন এই তালিকায়। রয়েছে ব্র্যাকের মতো সুশীল সমাজের সংগঠন। দেশী অনেক স্বনামধন্য কোম্পানি এবং বিদেশীরাও। চা শ্রমিকদের শোষণের প্রশ্নে দেশীয় এনজিও, শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ, শীর্ষ মিডিয়া, ইউরোপীয়, ভারতীয়, সবার স্বার্থ মিলেমিশে একাকার। চা বাগানের শ্রমিকদের যে দাসোচিত অবস্থা এর জন্য দায়ী মূলত এসব প্রতিষ্ঠানই।
চা শ্রমিকরা আজ যে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করেছেন, এটা হচ্ছে জীবন রক্ষার দাবি। কোনো রকমে দম টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের এই মজুরি প্রয়োজন। কিন্তু বাঁচার মতো মজুরি কোনোমতেই ৩০০ টাকা হতে পারে না। তাদের অবশ্যই বাঁচার মতো মজুরি দরকার এবং সেটা কোনোমতেই দৈনিক ৫০০ টাকার কম নয়। এটা কি স্কয়ার গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকেরা জানে না? নাকি ব্র্যাকের এ বিষয়ক গবেষণা নেই? চা শ্রমিকদের এই দাসত্বের অবসান ঘটাতে এসব কোম্পানির জরিমানা হওয়া দরকার। মায়ের পেটে থাকতেই মানুষকে কিনে ফেলে মজুরি দাসত্বে আটকে ফেলা এসব কোম্পানির মালিকদের বিচার হওয়া দরকার।
১৪ আগস্ট ২০২২
আনিস রায়হান: লেখক, সাংবাদিক
আপনার মতামত জানানঃ