মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। সেখানকার অন্যতম বড় সামরিক শক্তি ইরান এখন বেশ খানিকটা কোণঠাসা। এতদিন বাইরে শত্রুদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ালেও এখন আর ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে শত্রুরা দ্বিধা করছে না। একের পর এক হামলা ও হস্তক্ষেপের ঘটনা বেড়েই চলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালে দেশটিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। অনেক ইরানির রক্তে রঞ্জিত সেই বিক্ষোভে শত্রুদের মদদ ও অর্থলগ্নির অভিযোগ আনে ইরানের শাসকদল।
এরপর ইরানের মাটিতে না হলেও তাদের প্রভাবিত এলাকার মধ্যেই হামলার শিকার হন রেভুল্যুশনারি গার্ডসের অভিজাত বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। তার মৃত্যুকে ইরান ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের টোপ, তাই তখন তারা ছিল সংযত। মার্কিন বাহিনীকে একটি জবাব দিয়ে মুখ রক্ষা করাটাই ছিল ইরানের নেতাদের সে সময়ের ভাবনা। তেমনটাই তারা করেছিল, ভেবেছিল এভাবে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
যুদ্ধ এখনো লাগেনি বটে, তবে কয়েক দফা ইরানের ভূখণ্ডে এমন কিছু জায়গায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে যে, এগুলোকে যুদ্ধকালীন হামলার সমানুপাতিক মনে করছে দেশটির সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ইরানের স্পর্শকাতর নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের জুলাইয়ে। সে সময় তেহরানের নিকটবর্তী একটি সামরিক স্থাপনা এবং একটি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সংস্থার পাশে একাধিক রহস্যময় বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। বুশেহর বন্দরে অন্তত ৭টি জাহাজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
ইরানি কর্মকর্তারা শুরুতে এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার না করলেও পরে আর ফেসবুক-টুইটারের কারণে তা চেপে রাখা যায়নি। পরবর্তীকালে বিদেশি হস্তক্ষেপ ও গোয়েন্দাদের দ্বারা এসব নাশকতা সংঘটিত হচ্ছে বলে অভিযোগ আনা হয়। বিভিন্ন শহরে বিস্ফোরণ ও হামলার ঘটনায় ইরানের নেতারা চাপ অনুভব করেন এবং সামরিক নীতি ও কৌশল পুনর্বিন্যাসের কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এক্ষেত্রে দেশটির শাসকদের কার্যক্ষমতা ও গতিকে সংকুচিত করে ফেলে। যে কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশলগুলো চূড়ান্ত ও প্রয়োগ করা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনও নতুন সামরিক কৌশল নির্ধারণে ইরানের শাসকদের কালক্ষেপণে বাধ্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসনের ক্ষমতাগ্রহণের সম্ভাবনা তাদের জন্য ছিল শাঁখের করাতের মতো। নতুন প্রশাসন এলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বহর কিছুটা লাঘব হবে বলে আশা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেই টোপ দিয়ে আবার নতুন করে কিভাবে চাপ সৃষ্টি করা হবে, এ নিয়েও ছিল শঙ্কা।
এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের জয় নিশ্চিত হতে না হতেই ইরানের ভূখণ্ড আবার প্রকম্পিত হয়েছে। এবার দেশটির অভ্যন্তরে নিহত হলেন একজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী। এটা স্পষ্ট যে, আততায়ী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে। হত্যার ধরনটা খুবই উদ্বেগজনক। এ থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, ইরানি নেতারা কেউই আর এখন ইরানের ভেতরেও নিরাপদ নন। প্রেসসিডেন্ট রুহানী, শীর্ষ নেতা খামেনি, সেনাপ্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা প্রায় সকলেরই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে, যে ধরনের যুদ্ধের অপেক্ষা ইরান এতদিন করে এসেছে, সে ধরনের যুদ্ধ আসলে হচ্ছে না। নতুন যুদ্ধটা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরানের বিরুদ্ধে আধুনিক ও সমন্বিত এক পরিকল্পিত যুদ্ধ শুরু করেছে। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, ইসরায়েল এক্ষেত্রে রয়েছে অভিযান বাস্তবায়নের দায়িত্বে। যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা যাচাই করছে, আর সৌদি-আমিরাত আছে অর্থায়নে।
ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে ইরানের শাসকদের নতুন পরিকল্পনা নিতে হতো এবং তা দ্রুত সময়ের মধ্যেই। সেটাই তারা করেছে। সব ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছুঁড়ে ফেলে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনই শত্রুদের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং শাসক দলের ক্ষমতা রক্ষার একমাত্র উপায় বলে মনে করছে অধিকাংশরা। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর একাংশের পর্যবেক্ষণ হলো, ইরানে বারংবার হামলার ঘটনায় শাসকদলের কট্টর অংশের শক্তি বাড়ছে। ক্ষমতাসীন রুহানী ও জাভেদ জারিফের মতো উদারপন্থি নেতারা কোণঠাসা হচ্ছেন। তবে ইরানি সংবাদমাধ্যমগুলোতে আনুষ্ঠানিক কিছু দ্বিমত ছাড়া, জোরদার বিভাজনের ইঙ্গিত মেলে না।
ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলোর বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, ইরানের শাসকরা এতদিন ধরে পশ্চিমা সভ্যতার বিপরীতে ইরানি শৌর্য-বীর্য ও শ্রেষ্ঠত্বের চেতনার আবাদ ঘটিয়েছে। ইরান শ্রেষ্ঠ ও অজেয়, এমন উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণাও যুবকদের মধ্যে প্রচার করেছে তারা। ইরানই সবচেয়ে বেশি সভ্য, এমনকি সভ্যতার জন্মই ইরানে, এমন প্রচারও সেখানে রয়েছে। ইসলামী বিপ্লব একমাত্র ন্যায়ের আধার, বাকি বিশ্ব চলছে অন্যায়ের ওপর দাঁড়িয়ে, এমন অন্তর্মুখী, বিশ্বায়নবিরোধী ধারণা শাসকদল জোর দিয়েই প্রচার করে আসছে। এখন ইরানের ওপর হামলা তাদের সেসব ভাবমূর্তিকে বিরাট সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে, তরুণদের এ সংক্রান্ত ক্ষোভ শাসকদের জন্য বাড়তি চাপও বটে। পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যার পর প্রতিশোধের দাবিতে তেহরানের রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে।
স্বদেশের ওপর বিদেশি শক্তির আগ্রাসন ঠেকাতে ইরানের শাসকরা বদ্ধপরিকর। নিজেদের শক্তির ওপর ভর করে দীর্ঘদিন ধরে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই টিকে আছে এবং বিকশিতও হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইরত জাতি ও জনগণ ইরানের বিদেশি আগ্রাসনবিরোধী লড়াইকে তাই সম্মান ও সমর্থন করে। বিশ্বজুড়ে ইরানের প্রতি এই সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতা সুসংহত করেছে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসা শাসকশ্রেণী।
ইদানীংকার হামলাগুলো দেশের ভেতরে ও বাইরে ইরানের শক্তি-প্রতিপত্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ইরানকে এটা মোকাবিলা করতেই হবে। নতুন ধরনের যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, সেখানে তাদের যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, এমন তাগিদ অনুভব করছেন নীতি নির্ধারকরা। তবে ইরানের সরকার এখনো চরম কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যায়নি। ইরানে হামলা হলে মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাবে, এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে দেয়াটা ছিল ইরানের কৌশল। কিন্তু এখন সেই কৌশলই পাল্টা চাপ সৃষ্টি করছে।
ইরানের শাসকরা যুদ্ধ চায় না, এটা জোর দিয়েই বলা যায়। অর্থনীতির সংকট এবং আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ যত কমবে, ইরানে ক্ষোভ তত বাড়বে, এটা তাদের অজানা নয়। জনগণের চাপেই তারা যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে রাখতে বাধ্য। তাছাড়া সর্বাত্মক যুদ্ধ লেগে গেলে ইরানের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি যতটা নিশ্চিত, শাসকদের টিকে থাকার সম্ভাবনা ঠিক ততটা নিশ্চিত নয়। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শত্রুদের ভয় পাইয়ে দিতে কিংবা অন্তত তাদের সংযত দেখতে চায় ইরানের শীর্ষ মহল। এরই অংশ হিসেবে খোঁজা হচ্ছে নতুন কৌশল।
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চোখে পড়ছে, পরমাণু ইস্যুতে ফের কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইরান। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দেশটির পার্লামেন্ট একটি আইন পাস করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে ইরানের ওপর আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি অনুযায়ী পরমাণু স্থাপনাগুলোতে জাতিসংঘের পরিদর্শন বন্ধ ও ৩.৬৭ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম উৎপাদন করবে সরকার।
বোঝা যাচ্ছে, এই আইন প্রয়ণের মধ্য দিয়ে পরমাণু চুক্তির ইউরোপীয় অংশীদারদের কড়া হুমকি দিয়েছে দেশটি। দ্রুতই পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির পথগুলোও পরিষ্কার রাখতে চাইছে তারা। এখানেই হয়তো তারা থামবে না। চীনের মহাবিনিয়োগ ও ইরানে চীনা সেনার উপস্থিতি নিশ্চিতের যে চেষ্টা ইরানের শাসকদল করে আসছে, সেই প্রক্রিয়া এখন আরো গতিশীল হবে ধারণা করা যায়। ইরান আত্মরক্ষার্থেই ইসরায়েলি পরিকল্পনাকারীদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে।
শত্রুদের দাবিয়ে রাখতে ইরানের শাসকদের পরিকল্পনাগুলো কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো অস্পষ্ট। তবে এটা পরিষ্কার যে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এখন আরো সরগরম হবে। সেখানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধাস্ত্র প্রেরণ বাড়বে। ইরানের শাসকদের জন্যও সামনের দিনগুলো ক্রমাগত কঠিনই হতে থাকবে। জাতীয়তাবাদ প্রচারের দায় তাদের মেটাতে হবে। আবার বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতার রাজনীতিটাও তাদের জন্য দুর্বল হয়ে গেছে, কারণ তারা নিজেরাও সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত।
৪ ডিসেম্বর ২০২০
raihananis87@gmail.com
আপনার মতামত জানানঃ