সরকারি তথ্যে কৃষির বিপর্যয়কর চিত্র ফুটে উঠেছে। জানা গেছে, দেশের মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে ফি বছরে অন্তত ৪০ হাজার টন কীটনাশক এবং ৫৫ হাজার টনের বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারগুলো হয়ে পড়েছে অ্যান্টিবায়োটিকনির্ভর। হাইব্রিড তথা অতি ফলনের দিকে ঝুঁকে পড়া এহেন কৃষি ব্যবস্থা দেশবাসীর স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার পক্ষে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানবদেহে। নিয়মনীতি ছাড়াই খাদ্যপণ্যে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের কারণে মানবদেহের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ছে। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। এমনকি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে গর্ভের শিশুর ওপরেও। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভায়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির আওতায় পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিখাতে যে সংস্কার চালানো হয়, তাতেই প্রথম কীটনাশক ও রাসায়নিক সারনির্ভর অতি ফলনের কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এরপর বাংলাদেশে ফিলিপাইনভিত্তিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইরি’র চাষাবাদ প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়। এই চাষাবাদ প্রযুক্তি পুরোটাই সার, অতিরিক্ত পানি ও কীটনাশকনির্ভর। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অসংখ্য এনজিও হাইব্রিড বা অতি ফলনের এই কৃষিব্যবস্থার পক্ষে ওকালতি করে।
ক্ষুধা নির্মূলের কথা বলে প্রচলন ঘটানো হয় এহেন কৃষির। কৃষকদের নানা উপায়ে উদ্বুদ্ধ করা হয় নিজস্ব জাতের ধানচাষ বন্ধ করে হাইব্রিড চাষাবাদে। শুরুর দিকে কৃষকরা সাড়া না দিলে, সারনির্ভর বড় জাতের ফসলের প্রতি ভোক্তাদের আকর্ষিত করা হয় নানা উপায়ে। ভোক্তাচাহিদা তুলে ধরে কৃষকদের মধ্যে মুনাফার সুযোগের বিষয়টি প্রচার করা হয়। অমুক কৃষক হাইব্রিড ফসল চাষ করে কোটিপতি হয়ে গেছেন, এমনতর সংবাদ প্রচার করা হয় টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায়। এভাবে নানা কৌশল প্রয়োগ করে বাংলাদেশে আশি ও নব্বইয়ের দশকজুড়ে এই হাইব্রিড কৃষির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।
কিন্তু হাইব্রিডে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমার দাবি করা হলেও এর অন্যান্য ক্ষতিকর দিকগুলো আরও বড় শঙ্কাকেই সামনে নিয়ে আসছে। এখন বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে গেলে দেখা যাচ্ছে পোকামাকড়ের কবল থেকে শাক-সবজি রক্ষার্থে অবাধে ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করা হয় কৃষি কর্মকর্তা ও পণ্য বিক্রেতাদের পরামর্শেই। রকমারি কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে নেই কোনো নিয়মনীতি। অথচ এসব কীটনাশক জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের জন্য হুমকিস্বরূপ। অধিক মুনাফার লোভ দ্বারা চালিত হচ্ছে দেশের কৃষি ও সরকারের কৃষি দর্শন।
জানা যায়, পোকামাকড়ের কবল থেকে শাক-সবজি রক্ষা করতে জমিতে অবাধে কীটনাশক স্প্রে করে সেই দিন অথবা পরদিনই তা বাজারজাত করা হয়। এ রকম তাজা কীটনাশক দেয়া খাবার খেয়ে ব্রঙ্কাইটিসসহ শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা, কিডনি ও লিভারের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এমনকি গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটিযুক্ত বা অসুস্থ সন্তান জন্ম নিচ্ছে। এসব শাকসবজি খাওয়ায় মানবদেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর রাসায়নিক অতিব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ধ্বংস করতে গিয়ে ফসলের উপকারী পোকামাকড়ও ধ্বংস হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ফসলের মাঠ গড়িয়ে খালে বিলে যাচ্ছে। এত খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে নানা জাতের পাখি ও প্রাণী।
২০১৫ সালে সরকারের জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি শীতের সবজি ফুলকপি ও লালশাকের নমুনায় কীটনাশকের রাসায়নিক মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। ওই বছরের ১ থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণা এসব সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনের জন্য কৃষক পর্যায়, পাইকারি বাজার এবং খুচরা বাজার থেকে একাধিক নমুনা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষার পর দেখা গেছে কৃষক পর্যায়ে এসব নমুনায় ফুলকপির ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কীটনাশক ম্যালাথিয়ন কেজি প্রতি ২৫১ মাইক্রোগ্রাম।
যার স্বাভাবিক মাত্রা কেজি প্রতি ২০ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ সবজিতে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ১২ গুণ বেশি কীটনাশকের উপস্থিতি ছিল। একইভাবে ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক ক্লোরোপাইরিফিস পাওয়া যায় কেজি প্রতি এক হাজার ৬০৫ মাইক্রোগ্রাম। যার স্বাভাবিক মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে সবজিতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই রাসায়নিকের মাত্রা ছিল ৩২ গুণ বেশি। তবে এই পরিস্থিতির এখনও উন্নত হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে দেশে কৃষি খাতে ৩৫ হাজার ৫২৩ টন কীটনাশকের ব্যবহার করা হয়। ২০১৬ সালে কিছুটা বেড়ে ৩৫ হাজার ৭২৩ টন উন্নীত হয়। পাশাপাশি ২০১৭ সালে ব্যবহারের মাত্রা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ২৫৮ টন। অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৮ সালে আরেক দফা বেড়ে দেশে ফসলে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় ৩৯ হাজার ২৩৭ টন।
অধিদফতর সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে কৃষি খাতে রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়েছে ৩৯ লাখ ৯৫ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ লাখ ১ হাজার টনে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৩ লাখ ৪৬ হাজার টন। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যবহার হয় ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে হয় ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টন। অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে আরেক দফা রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় ৫৫ লাখ ৯০ হাজার টন।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যমতে, আইপিএম কর্মকাণ্ড, সুষম সার ব্যবহার, কীটনাশক ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি, উদ্বুদ্ধকরণ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার কমেছে। তবে শাকসবজি, ডাল, তেল এবং মসলা জাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, ফলবাগানের সংখ্যা বাড়ায় আগাছানাশকের ব্যবহার বেড়েছে। একই সঙ্গে ছত্রাকনাশকের ব্যবহারও বাড়েছে। এসব কারণে বর্তমানে কীটনাশকের ব্যবহারও তুলনামূলক বেড়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে সঠিকভাবে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের উপায় নিয়ে কাজ চলছে। সেভাবে অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সবার প্রচেষ্টায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক ব্যবহার কমছে। ভোক্তাদের বিষমুক্ত সবজি সরবরাহে কৃষকদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে অর্গানিকভাবে উৎপাদিত সবজি ভোক্তার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের বাজার স্থাপন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পশু-পাখি পালন খামার এবং মৎস্য খামারগুলোতে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগ-জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে অসুস্থ হওয়ার পরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কোনো সুফল পাওয়া যায় না।
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ২০১৫ সালের ওয়ার্ল্ড হেল্থ অ্যাসেম্বলিতে অ্যান্টিবায়োটিককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ নীতিনির্ধারণী ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে। সংস্থা ২০১১ সাল থেকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স নিয়ন্ত্রণ রাখার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বিষয়টি ইতোমধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে কৌশলপত্র, কর্মপরিকল্পনা, ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতো ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর এবং প্রাণী ও মৎস্য সম্পদ অধিদফতর একই ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ না করলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য হবে না।
এসডাব্লিউ/ডিজে/আরা১১১০
আপনার মতামত জানানঃ