বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি অস্বাভাবিক দ্রুততায় কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খাদ্য, জ্বালানি ও কাঁচামাল ছাড়া বাদবাকি আমদানি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক বড় বড় এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমদানি অর্থনীতিকে এভাবে নিরুৎসাহিত করলে ডলার হয়তো বাঁচবে, কিন্তু রপ্তানি বাঁচবে কি? আমাদের রপ্তানিও যে আমদানিনির্ভর! এবং সার্বিকভাবে কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতি বাঁচবে কি? অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে চায়।
সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু
১. ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (নেট ওপেন পজিশন বা এনওপি) হ্রাস।
২. রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন করার বাধ্যবাধকতা।
৩. ইআরকিউ হিসেবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা, আদায় করা রপ্তানি আয় জমা রাখার সীমা অর্ধেক করা।
৪. অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর এবং তহবিল স্থানান্তরের সীমাবদ্ধতা শিথিল। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটগুলো সরকারের মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্প কাঁচামাল ও আমদানির মূল্য পরিশোধের অর্থের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দেশীয় ব্যাংকে ৬ মাসের জন্য জমা রাখা। ব্যাংকগুলোকে অফশোর ব্যাংকিংসহ সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।
৫. ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যেকোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ। এ ছাড়া পাঁচ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি লেনদেনের জন্য প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
৬. ডলার-সংকট ঠেকাতে আমদানি এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ১৮ জুলাই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের প্রায় আড়াই কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা স্থগিত করেছে। অতীতে বৈধ ঋণপত্র আটকে দেওয়ার এমন ঘটনা ঘটেনি।
৭. আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী থাকায় স্পট মার্কেট থেকে প্রাথমিক জ্বালানি কেনায় বড় অঙ্কের লোকসান ছাড়াও ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস-তেল সরবরাহ কমিয়ে লোডশেডিং শুরু করা হয়েছে দেশব্যাপী। সরকারের কাছে সর্বোচ্চ মাত্র ৪০ দিনের জ্বালানি তেলের রিজার্ভ আছে। এটা সম্ভাব্য জ্বালানি সংকটের আলামত। সরকার ১১২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত।
গোড়ায় গলদ
বিদ্যুৎখাতে বেড়ে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা, বিদায়ী অর্থবছরে যা ছিল ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরকারের কাছে দেড় বিলিয়ন ডলার পাওনা দাবি করেছে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকিতে লোকসান হচ্ছে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি টাকা। সরকার সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ, রাত আটটার পরে দোকানপাট বন্ধ করা, দিনে এক-দুই ঘণ্টা বাধ্যতামূলক লোডশেডিং, অফিস সময় এক-দুই ঘণ্টা কমানোর মতো অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব উদ্যোগে আমরা ধরে নিতে পারি যে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মন্দা’ পরিস্থিতির সূচনা হলো। বেসরকারি খাত যা আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারের ৮৯ শতাংশ, তাতে সরকারের সংকোচন নীতি-কৌশল চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তথাপি সরকারের নিজের আমদানি ক্রয় এবং জনপ্রশাসন ব্যয়ে বড় সংকোচন আসেনি।
অপ্রয়োজনীয় ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প থামানোর উদ্যোগ নেই। বেশি জ্বালানি পুড়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা ভাড়া ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিলের মতো প্রত্যক্ষ ঘোষণা আসেনি। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটেও সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন উপলব্ধি নেই। কমিশনবান্ধব ‘স্পট মার্কেট’-এর বদলে ওপেকভুক্ত বড় তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারীদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ও স্থায়ী জ্বালানি সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত ‘জ্বালানি কূটনীতি’ নেই।
নেই দেশের গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য হাতে থাকা সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। নিরুৎসাহিত করার পরেও শ খানেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। বিদেশে লবিস্ট কিংবা পিআর ফার্মের খরচ কিংবা বাংলাদেশ দূতাবাসে কৃচ্ছ্রের উদ্যোগও নেই। নেই শ্রমবাজার বাড়ানো কিংবা স্বল্প খরচে প্রবাসী পাঠিয়ে রেমিট্যান্স আয়ের কার্যকর উদ্যোগ।
অর্থাৎ বেসরকারি খাতে সংকোচন চাপানো হলেও সরকারি খাতে ‘ডলার ব্যয়’ কমানোর পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। তবে সুশাসন ও জবাবদিহি নেই বলে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে বলে নতুন বিধিবিধানের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রশ্রয় পাওয়ার আশঙ্কা আছে, কেননা, প্রভাবশালীরা ফাঁকফোকর বের করে ‘ডলার পাচার’ চালিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা আছে।
নিরীক্ষণ কাঠামোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ অবশ্যই দরকারি। কিন্তু রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের রেগুলেটরি অডিট, বেসরকারি ব্যাংকের নস্ট্র অ্যাকাউন্টে পরিমাণমতো ডলার রাখার স্বচ্ছতা মনিটরিংয়ের রাজনৈতিক সততা অনুপস্থিত।
অর্থাৎ ডলার বাঁচানোর প্রত্যক্ষ উদ্যোগের বদলে সরকারের উদ্যোগ অপর্যাপ্ত এবং কিছু ক্ষেত্রে পরোক্ষ, এখানে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের বাঁচানোর চেষ্টা থাকতে পারে। এলসি বা ঋণপত্র খোলা নিরুৎসাহিতকরণ অর্থনীতিতে বেশ গভীর প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করি।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে রপ্তানি বাণিজ্য
শতভাগ মার্জিনে এলসি খোলার বাধ্যবাধকতার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ীর হাতের প্রবহমান পুঁজি আটকে দেওয়া, এতে আমদানি ও রপ্তানি উভয় বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জিনিসপত্রের দাম আবারও বাড়বে। বহু প্রয়োজনীয় আমদানি আটকে যাবে এবং শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হবে, এটা নিশ্চিত। এতে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বাড়বে এবং রপ্তানি আয় কমে যাবে।
সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে চায়। যদিও বিগত এক দশকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৌশল যতটা রেগুলেটরি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। ‘টাকা ও ঋণ প্রাপ্তিকে সস্তা’ করার অপরিণামদর্শী মুদ্রানীতি, দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতিতেও এক অঙ্কের সুদ চালানো, জনপ্রশাসনের খরচ বাড়াতে রাজস্ব আয়ের চেয়েও বেশি ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র ঋণ, খোদ বাংলাদেশ ব্যাংককের কাছে সরকারের বন্ড বিক্রির অন্যায্যতা, বেপরোয়া মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকিং খাতে অপশাসন, পরিবারতন্ত্র কায়েম, দুর্বৃত্তদের ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া, কালোটাকা ক্রমাগত সাদাকরণ ও পাচারবান্ধব নীতিমালা, ঋণ প্রদানে কোলাটেরাল কমিয়ে দেওয়া, ঋণখেলাপিদের অবিশ্বাস্য সব সুযোগ দেওয়া—সবই ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নতুন ধনী তৈরির প্রক্রিয়া এবং চুইয়ে পড়ার সুফল কেন্দ্রিক ‘উন্নয়ন’ নীতিতে।
এখন সংকটে এসে লুটেরাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকার অপারগ বলে রেগুলেটরি বা নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্তের তীব্রতা দেখছি আমরা। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একতরফা কৌশল ফল দেবে কি? বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের পরে তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ারবাজার সূচকও পড়তে শুরু করেছে। সংকটের যে অংশটুকু দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের ফল, তা পরিবর্তন করা না গেলে শুধু রেগুলেটরি বিধিনিষেধে কাজ কম হবে।
সরকারি হিসাবে রিজার্ভ এখন ৩৯.৭ বিলিয়ন ডলার, তবে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী আইএমএফের অনানুষ্ঠানিক হিসাবে তা ৩২.৫ বিলিয়ন ডলার। একই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ, নন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড, বিভিন্ন সরকারি ব্যাংককে দেওয়া রিজার্ভ ঋণ, উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া রিজার্ভ ঋণ, শ্রীলঙ্কা ও সুদানকে দেওয়া ঋণ ইত্যাদিসহ রিজার্ভ ঋণগুলো আটকে যাওয়ায় এসব রিজার্ভ খাতায় আছে কিন্তু হাতে নেই।
অর্থাৎ এই মুহূর্তে খরচের মতো রিজার্ভ অবিশ্বাস্যভাবে কম। ‘ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ বাড়াতে ইডিএফ (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) ঋণ ফেরাতে হবে। এবং বিশেষ করে ‘সভরেইন গ্যারান্টি’ ঋণের গভীরে যেতে হবে। গোপনীয় ‘সভরেইন গ্যারান্টি’ ঋণের বড় ‘বোঝা’ না থাকলে ‘ব্যবহারযোগ্য’ ডলারের এমন সংকট অসম্ভব।
রপ্তানিকারকেরা যদি ডলারের ইডিএফ ঋণের একটি অংশ পাচার করে থাকেন, সেটি এলসি অডিট করেই জানতে হবে এবং তা ফেরাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হবে, এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকৌশল কাজ করবে না। ঋণখেলাপিদের গৎ বাঁধা সুদ ছাড় দিলে (১০ শতাংশের জায়গায় ৪ শতাংশ) কাজ হবে না, আগেও হয়নি, ব্যবসায়িক দুর্বৃত্তপনা সরকারের জানাশোনার বাইরে হয়নি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ