দেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া ভেঙে গেলে ঠিক কী হয়, তা তো শ্রীলঙ্কাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। খাবার নেই, তেল নেই— ভেঙে পড়া রাজনৈতিক কাঠামো গোটা দুনিয়ার সামনে শ্রীলঙ্কাকে একটা উদাহরণ হিসাবে এসেছে।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মিয়ানমার এখন বিপর্যয়ের খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পর মিয়ানমারের অর্থনীতিতে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। দেশটিতে রিজার্ভ সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। যেনতেনভাবে ডলারের রিজার্ভ বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সামরিক জান্তা। এরই মধ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব ধরনের বিদেশী ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পর মিয়ানমারই এখন রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্বের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে।
মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক আদেশে স্থানীয় ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোকে বিদেশী ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আদেশটির মাধ্যমে বৈদেশিক লেনদেনে বর্মি কোম্পানিগুলোর প্রদেয় সব ধরনের বিল পরিশোধ আটকে দেয়া হয়েছে।
এই অবস্থায় বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে মিয়ানমারের পক্ষে হয়তো সামনের দিনগুলোয় রাষ্ট্রীয় দায়দেনা পরিশোধ করাও অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। তাদের ভাষ্যমতে, মিয়ানমারে মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বার্তা সংস্থার খবরে বলছে, বিদেশ থেকে বিলাসপণ্যের পাশাপাশি খাদ্যপণ্য, ওষুধ ও জ্বালানি আমদানিতেও এখন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভেঙে পড়েছে সামাজিক ব্যবস্থাও। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বার্তা সংস্থাগুলো বলছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এরই মধ্যে মিয়ানমার ছেড়েছে বেশকিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ দেশটি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে জ্বালানি খাতের ফরাসি জায়ান্ট টোটাল এনার্জি। দেশটির জ্বালানি তেল ও গ্যাসে বিনিয়োগকারী দুই বিদেশী প্রতিষ্ঠান শেভরন ও উডসাইডেরও বিনিয়োগ প্রত্যাহার কার্যক্রম পুরোপুরি সম্পন্নের পথে।
বিদেশ থেকে বিলাসপণ্যের পাশাপাশি খাদ্যপণ্য, ওষুধ ও জ্বালানি আমদানিতেও এখন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভেঙে পড়েছে সামাজিক ব্যবস্থাও। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এমন আরো অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানই এরই মধ্যে মিয়ানমার থেকে বেরিয়ে এসেছে বা বেরোনোর পথে। এর পরও যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান সেখানে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, ডলার রিজার্ভ নিয়ে বর্মি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান অবস্থানের কারণে সেগুলোর এখন মিয়ানমারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্ট এ রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবশেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে সেই দেশে। ঠিক সেই সময় মিয়ানমারে বাড়ছে হিংসা এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক মন্দা।
দেশের স্বাধীনতার নায়ক এবং ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চি-র বাবার হত্যার ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে মিয়ানমার জুড়ে বিক্ষিপ্ত গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ চলছে। একই সময় দেশের মুদ্রার আরও অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলার প্রতি ২,৪০০ দরে বিক্রি হচ্ছে সেই দেশের মুদ্রা।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৫ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ সহ সমস্ত সংস্থাকে ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার হোল্ডিংগুলিকে স্থানীয় মুদ্রা কিয়াটে রূপান্তর করার নির্দেশ দেয়। এরপরেও অব্যাহত রয়েছে মন্দা। এই নিয়মটি আরও ব্যবসা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কিয়াটের উপর চাপ কমাবে বলে মনে করা হয়।
১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১-এ অভ্যুত্থানের একদিন আগে, মার্কিন ডলারের সামনে কিয়াটের মূল্য দাঁড়ায় ১,৩৪০। মিয়ানমারে খাদ্য ও জ্বালানীর দাম বেড়েছে। কিয়াটের মূল্য হ্রাসের পরে বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন যে দেশের এই সংকট আরও গভীর হতে পারে।
অন্যদিকে, মিয়ানমারে হিংসা বেড়েই চলেছে। সামরিক শাসক গণতন্ত্রপন্থী কণ্ঠের উপর আঘাত অব্যাহত রেখেছে। যদিও মঙ্গলবারের বিক্ষোভ নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে অল্প সময়ের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
মিয়ানমারের উদার গণতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বলেছে যে, অভ্যুত্থানের পর থেকে ৪৮ এনএলডি নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। ৯০০-রও বেশি দলীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এনএলডির হিউম্যান রাইটস রেকর্ড গ্রুপের মুখপাত্র কিয়াও হটওয়ে জানিয়েছেন দলের ১১ জন নেতা আটক অবস্থায় মারা গিয়েছেন এবং আটজনে মৃত্যু হয়েছে কারাগারে।
মিয়ানমারের বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার, যারা নিজেকে দেশের বৈধ প্রশাসন বলে মনে করে, জানিয়েছে যে তারা তার বাজেটের ৯৫ শতাংশ ব্যয় করেও নিজেদের সশস্ত্র শাখার জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে অক্ষম। তারা আরও জানিয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এনইউজির সশস্ত্র শাখার ২৫৯টি টাউনশিপ-ভিত্তিক ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এর প্রায় ৮০,০০০ থেকে ১০০,০০০ সদস্য রয়েছে। এনইউজি আরও দাবি করেছে যে বেশিরভাগ গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে।
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ডলারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার পেছনে আরেকটি বড় উদ্দেশ্য হলো যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। গণতন্ত্রপন্থী ও জাতিগত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী স্থল আক্রমণের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
এজন্য সাম্প্রতিক সময়ে বিমান হামলার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে সামরিক জান্তা। এই বিমান হামলা অব্যাহত রাখতেও তাদের উড়োজাহাজে ব্যবহার্য জ্বালানি তেল প্রচুর পরিমাণে কিনতে হবে আর তা শুধু ডলারেই কেনা সম্ভব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ