দেশে কয়েকদিন পরপরেই শোনা যায় কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আপেক্ষিক। এরপরেও যদি কেউ মনে করে যে কোন ঘটনা তার ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে; তাহলে দেশের আইন আদালত সব আছে, তিনি আইনের দারস্থ হতে পারেন। কিন্তু গত কয়েকটি দশকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে বিভিন্ন সময়ে কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্মমভাবে আক্রমণসহ তার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টিতে দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাকস্বাধীনতা দিনেদিনে হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত জুনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫ জন। এর বাইরে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ৩ মামলায় ৩১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
দেশে এসব ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক আগে ভারতে নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আলোচিত নেতা নূপুর শর্মা। তার মন্তব্যে ভারতের মুসলমানদের পাশাপাশি গোটা মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ ছড়ায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে নূপুরকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিজিপি। ওই ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ায় বাংলাদেশেও। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে জুনের মধ্যভাগে বেশ কয়েকটি মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে।
নূপুর শর্মার সমর্থনে ১৭ জুন ফেসবুকে পোস্ট দেন নড়াইল মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থী। এ ঘটনার জেরে পরদিন দিনভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
এরপর পুলিশ পাহারায় স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
এদিকে নূপুর শর্মার সমর্থনে পোস্ট দেয়া হিন্দু শিক্ষার্থী রাহুল দেব রায়ের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাহুলের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন মির্জাপুর হাজিবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন।
ধর্ম অবমাননার মামলার প্রায় দেড় সপ্তাহ পর শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় আরেকটি মামলা করে পুলিশ। সেই মামলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় অভিযোগে গত ১৭ জুন সিলেটে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শ্রাবণ সাঁওতাল রাজ জাফলং চা বাগানের বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র।
তার বিরুদ্ধে গোয়াইনঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইমরুল কবীর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। এই মামলায় কারাগারে আছেন রাজ।
বাগেরহাটের চিতলমারীতে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে কলেজছাত্রী রনিতা বালাকে ১৯ জুন হেফাজতে নেয় পুলিশ। সেদিন থানায় হামলা চালায় একদল মানুষ। এতে আহত হন অন্তত ১২ পুলিশ সদস্য।
ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা করেন শেরেবাংলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন মুন্সি। ওই মামলায় রনিতা কারাগারে আছেন।
খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের কিংকর কুণ্ডুর বিরুদ্ধে ১৪ জুন তার ফেসবুক আইডি থেকে মনবী মুহাম্মদকে নিয়ে কথিত কটূক্তির অভিযোগ ওঠে। এর দুই দিন পর স্থানীয় কয়েক যুবক তার বাড়িতে হামলা করে ও খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও পুলিশ গিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।ওই রাতেই কিংকর কুণ্ডুকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর হোসেন মামলা করেন।
খুলনায় আরেক ঘটনায় ইসলামি বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীর একটি ওয়াজের পোস্টে বিতর্কিত কমেন্ট করার অভিযোগে ২৮ জুন কয়রা উপজেলায় উৎপল মণ্ডলকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও জনরোষ তৈরির অভিযোগে কয়রা থানার উপপরিদর্শক মো. ইব্রাহিম মামলা করেছেন। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট শেয়ারের অভিযোগ ওঠে যশোরের চুড়িপট্টি এলাকার একটি জুয়েলারি দোকানের কর্মচারী অনুপ সাহার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ১৩ জুন বিকেলে জেলা পোস্ট অফিসসংলগ্ন মসজিদের সামনে তাকে পিটুনি দেয় স্থানীয়রা। পরে তাকে পুলিশে দেয় তারা।
বারবার একইভাবে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ এবং পরে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা এসবের পেছনে একধরণের রাজনীতি আছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ম অবমাননার কথিত পোস্ট নিয়ে যে ব্যাপক প্রচারণা হয়, পরে বিক্ষোভের আয়োজন হয় এবং শেষে হামলার ঘটনা ঘটে এর পেছনে কোন একটা গোষ্ঠীর ভূমিকা আছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলেন, ‘কোন কথায় আমরা কতটা উত্তেজিত হবো তার কিন্তু একটা পলিটিক্স আছে। আমাদের মেয়েদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, নানারকম অনিয়ম হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কিন্তু মানুষ এতো হাজারে হাজারে লাখে লাখে জড়ো হচ্ছে না।’
‘আজকে আমাদের দেশে এই বাস্তবতা তৈরি হয়েছে যে, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেছে এ কথাটি যদি প্রচার করা যায়, তাহলে কিন্তু যে কোন বিপর্যয় করা সম্ভব।’
বারবার একইভাবে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ এবং পরে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা এসবের পেছনে একধরণের রাজনীতি আছে বলেই মনে করেন তারা।
তাদের মতে, এই রাজনীতি হচ্ছে সরকার এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী উভয় পক্ষ থেকেই।
ধর্মকে রাষ্ট্র কিভাবে ডিল করে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এখানে হেফাজতের উত্থান হয়েছে, ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকে অনেক বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার। এখানে একটা ভোটের রাজনীতিও আছে।’
‘সরকারও আসলে একটু নড়বড়ে এখানে। সেও মনে করে যে ধর্মকে নিয়ে যারা রাজনীতিটা করছেন তাদের বিরুদ্ধে গেলে তার ভোটের হিসাব-নিকাষ কী হবে? ফলে যে বার্তাটি যেভাবে যত জোরালোভাবে দেয়া দরকার ছিলো সেটা দিচ্ছে না। কিন্তু এতে করে ঘটনার পুনরাবৃত্তিও তো ঠেকানো যাচ্ছে না।’
বিশ্লেষকরা বলেন, কোন ধর্মীয় টেক্সটে যদি কোন বিষয়ের উল্লেখ থাকে, সে বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করলেও কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হবে? বিষয়গুলি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। এ কারণেই সমস্যাগুলো দিনেদিনে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের চর্চা করা মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। নারী, অমানবিকতা, বর্বরতা, নৃশংসতার নির্দেশনা যদি কোন ধর্মীয় টেক্সটে থাকে, এরপরেও সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে কি যাবে না তা আমাদের কাছে পরিস্কার না। আমরা দেখলাম বিষয়গুলোর উপরে একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিতেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা প্রচণ্ড একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি দেখি। সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ থেকে যদি কারও নামে ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ করা হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিটি অপরাধ করেছেন কি করেননি এটা যাচাই না করেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি যদি সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। বিষয়টি দিনে দিনে সংখ্যালঘুদের কাছে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো বাকস্বাধীনতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ