পাকিস্তানের দুর্দশা নিয়ে দেশটির লেখক সাদত হোসেন মান্টোর একটি উক্তি ফেসবুকে পোস্ট করায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রীতমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী মাহবুব আলম ভুঁইয়া।
সে মামলায় শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল শহরের একটি বাড়ি থেকে প্রীতমকে গ্রেপ্তার করা হয়। শ্রীমঙ্গল থানার ওসি (পরিদর্শক-তদন্ত) হুমায়ুন কবির এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, গত ৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি করেছিলেন মাহবুব।
পাকিস্তানের জনপ্রিয় লেখক মান্টোর একটি উক্তি গত ৮ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রীতম। এর ঠিক আগের দিন ৭ জুলাই একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ‘নও পাকিস্তানি নও বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি লেখায় পাকিস্তানের দুর্দশার বর্ণনা করতে গিয়ে মান্টোর ওই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন। সেই লেখা থেকে নেয়া মান্টোর উদ্ধৃতি নিয়ে পোস্ট দেয়ার পর প্রীতমের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগ তোলেন শ্রীমঙ্গল পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন।
আর এই ঘটনা আমাদের আবারও ইসলামের অতিপ্রখর ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে চিরায়ত এক উপলব্ধি সামনে দাঁড় করায়। বর্তমান পৃথিবীতে ধর্মীয় কটূক্তি ও অনুভূতির ঘটনা দেখলে মনে হবে পৃথিবীতে ধর্ম আছে শুধু ইসলাম। যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেও তেমন তাদের কোমল অনুভূতিটি আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে তেমনি যেখানে তারা সংখ্যালঘু সেখানে তাদের কোমল অনুভূতিটি ধ্বংসের মুখে পড়ছে। ফলে উন্নত রাষ্ট্রগুলোও প্রতিনিয়ত অর্থ ব্যয় করে মাকড়সার বাসায় ন্যায় অনুভূতিটি প্রতিনিয়ত হেফাজত করছে।
কথায় কথায় বাঙালি মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। তাদের অনুভূতি কি ক্রমশই প্রখর হচ্ছে? নাকি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি আসলে রাজনৈতিক। তবে তা-ই যদি হয় তাহলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ভোট পায় না কেন? ওদিকে দেখি, বড় বড় দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলাম অনেক বেশি ঠাঁই পায়। মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না এমন অঙ্গীকারও করা হয়।
রাজনীতির বাইরে ভাবলেও, ব্যক্তিজীবনে আমরা ইসলামের অনুশাসনগুলো ঠিকমতো পালন করি না। কিন্তু ইসলাম নিয়ে একটি ‘এদিক-সেদিক’ কথা কথা বললেই আমাদের অনুভূতির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেমন, ধরা যাক, ঘুষ ও দুর্নীতি। এর বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান পরিস্কার। তাহলে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বারবার চ্যাম্পিয়ন হয় কী করে? নিশ্চয়ই আমরা ইসলামের বাণী অনুসরণ করি না!
দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন আমাদেরকে দুর্নীতিতে সারা বিশ্বে ‘নাম্বার ওয়ান’ বলে চিহ্নিত করে, তখন আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। মুসলিম-অধ্যুষিত একটি দেশকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে ‘গাল’ দিলেও মুসলমান হিসেবে আমরা আহত হই না। যখন ঘুষ খাই, কালোবাজারি করি, মিথ্যা বলি, অপরকে গালাগাল দিই, পরনিন্দা-পরচর্চা করি, তখন আমাদের ইসলাম থাকে কোথায়? প্রায় সব নির্বাচনের পরেই দেখি ভোট না দেওয়ার আভিযোগে হিন্দু বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়, হিন্দু নারী ধর্ষণ করা হয়, পুজার সময় প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়, মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়– এগুলো করে কারা? বরাবরই করে আসছে আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা।
রামুর ঘটনা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। এদেশের শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ৩০০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও জেনেছি আক্রমণকারীদের পরিচয়, তারা ‘মুসলমান’। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত— সব দলের পরিচয় একাকার হয়ে গেছে ওখানে। আক্রান্তরা ‘বৌদ্ধ’, আক্রমণকারীরা ‘মুসলমান’।
রাজনীতির বাইরে ভাবলেও, ব্যক্তিজীবনে আমরা ইসলামের অনুশাসনগুলো ঠিকমতো পালন করি না। কিন্তু ইসলাম নিয়ে একটি ‘এদিক-সেদিক’ কথা কথা বললেই আমাদের অনুভূতির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেমন, ধরা যাক, ঘুষ ও দুর্নীতি। এর বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান পরিস্কার। তাহলে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বারবার চ্যাম্পিয়ন হয় কী করে? নিশ্চয়ই আমরা ইসলামের বাণী অনুসরণ করি না!
তাই প্রশ্ন জাগে, আমাদের অনুভূতিটা আসলে কী, এটা থাকে কোথায়? রাজনীতির মাঝে, নাকি মনের ভেতরে? মনটাও কি রাজনৈতিক? নাকি আমরা ধরেই নিয়েছি অনুভূতির একক অধিকার মুসলমানদের!
বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে প্রথমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়। ১৮৬০ সালে এটি প্রণীত হলেও, ধর্ম অবমাননায় সাজার বিষয়টি যুক্ত করা হয় ১৯২৭ সালে। দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। এর মধ্যে মসজিদ, মন্দির কিংবা ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙা, ধর্মীয় অবমাননার উদ্দেশে খোঁচাখুঁচিমূলক লেখালেখি, নামাজ, পুজা ইত্যাদিতে বাধা দেওয়া, কবর ধ্বংস করা, শেষকৃত্যে বাধা দেওয়া, ধর্ম অবমাননাকর আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি অপরাধে সাজার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ ২ বছর কারাদণ্ড। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ধারায় ধর্মীয় বিদ্বেষে উস্কানি দিলে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার বিধানও রয়েছে।
ব্রিটিশরা যখন এই আইন করে তখন ইন্টারনেট বলে কিছু ছিল না। ইন্টারনেটেও যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যায় এটি বাংলাদেশের সরকার বুঝতে পারে ২০০৬ সালে। তখন বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায়। তাদের প্রণীত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন’ এ ধর্ম অবমাননার সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ এটা সংশোধন করে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ করেছে ১৪ বছর।
এসব আইনের কোথাও বলা নেই যে, ধর্মীয় অনুভূতি শুধু মুসলমানদেরই থাকবে। সব ধর্মের কথাই বলা আছে, কিন্তু আমরা এমন কোনো উদাহরণ খুঁজে পাই না যে, মন্দির ভাঙার দায়ে এই আইন প্রয়োগ হয়েছে। যে ক’টি উদাহরণ আমরা স্মরণ করতে পারি তার মধ্যে অতি সম্প্রতি ৪ ব্লগারকে আটক, ২০০৭ সালে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ র ফান ম্যাগাজিন ‘আলপিন’ এ কার্টুন প্রকাশের দায়ে কার্টুনিস্টকে ২ মাসের সাজাপ্রদান, তসলিমা নাসরিন ও হুমায়ুন আজাদের বই নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি। এসব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে।
এদিকে, ‘৭২ এর মূল সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু ছিল না। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী করে তাতে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করেন। অজুহাত হিসেবে বলা হয় যে, এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান, তাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই বিধান করা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, সংবিধানের এই ‘মুসলমানি’র আগে কি ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ছিল না?
ওই সংশোধনীতেই হাইকোর্ট বেঞ্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার বিধান করা হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেই বিধান ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ বলে বাতিল করে দিয়েছিল। বিচারপতিরা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হনন করার বিষয়টি বাতিল করার সাহস দেখাননি। তারাও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টিতে ‘সম্মান’ দিয়েছেন!
তারাই যখন আবার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে ‘৭২ এর সংবিধানে ফেরত গিয়ে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করতে বলেন, তখন রাষ্ট্রধর্মটি বাতিল করার কথা বলেন না।
ধর্মনিরপেক্ষ নীতির দল আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অজুহাত দেখিয়ে সংবিধান সংশোধন করে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে ”হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মপালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন” লিখে দিয়ে দায় সেরে নেয়।
সংবিধানের এ রকম কাটাছেঁড়া নিয়ে কারও তেমন উচ্চবাচ্য দেখি না। অন্য ধর্মের মানুষের অনুভূতি কী হচ্ছে সে খোঁজও আমরা রাখি না। এমন সব ক্ষেত্রে আমরা সবাই ‘মুসলমান’ হয়ে যাই।
রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে এ রকম কেন করে? সংবিধানে ধর্মের উল্লেখ থাকলেই কী আর না থাকলেই-বা কী, এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলে না। ‘৭২ এর সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দটি ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এটা অন্তর্ভুক্ত করেন, এর আগে পর্যন্ত কি এদেশের মুসলমানরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলত না?
১৯৮৮ সালে, জেনারেল এরশাদের সময়ে, সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী করা হয়। তার আগে কি এদেশের মুসলমানদের ধর্মকর্ম করতে সমস্যা হয়েছিল? প্রশ্ন জাগে, আমরা কি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এ বাস করছি, নাকি ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এ? কোন দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি? ধীরে ধীরে আমরা কেন এত ধর্মীয় ‘অনভূতিপ্রবণ’ হয়ে উঠছি?
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ