বর্তমান বিশ্বে ‘জিহাদ’ শব্দটি ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের কারণে অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ও কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ‘জিহাদ’ শব্দটিকে প্রায়শই সন্ত্রাসবাদ এবং হিংসার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে, যা বাস্তবিক অর্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামের ইতিহাস, কোরআন-হাদিস এবং ইসলামি শিক্ষাবিদদের ব্যাখ্যা অনুসারে, জিহাদ একটি ব্যাপক ও গভীর ধারণা, যার প্রধান লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং পাপাচার ও অন্যায় রোধ। জিহাদ হলো অন্তর থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে অন্যায় মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি।
ইসলামি ইতিহাসে জিহাদের প্রকৃত রূপ বোঝাতে গিয়ে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সময়ের যুদ্ধগুলো ছিল প্রতিরক্ষামূলক এবং ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো বদরের যুদ্ধ। হিজরতের পর মদিনায় আশ্রয় নেওয়া মুসলিমদের উপর যখন মক্কার কুরাইশরা আক্রমণ করতে আসে, তখন মুসলমানরা আত্মরক্ষার জন্য বদরের প্রান্তরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি কোনো আগ্রাসন ছিল না; বরং স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার রক্ষার একটি জিহাদি প্রয়াস ছিল।
আরেকটি উদাহরণ উহুদের যুদ্ধ। মক্কার কাফিররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এসে আক্রমণ চালায়। নবী (সা.) তখন আবারও প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন, কিন্তু যুদ্ধের মাঝখানে কিছু সাহাবির ভুলের কারণে মুসলমানরা কষ্টকর পরিণতির সম্মুখীন হন। এই যুদ্ধেও লক্ষ্য ছিল না কারো জমি দখল বা জাতিগত আধিপত্য; বরং মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা।
খন্দকের যুদ্ধ ছিল আরও একটি আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ, যেখানে ১০ হাজারের অধিক সৈন্য নিয়ে মদিনায় আক্রমণ চালানো হয়। নবী (সা.) তখন পারস্যের কৌশল অনুসারে মদিনার চারপাশে খন্দক (পরিখা) খনন করেন এবং সরাসরি যুদ্ধ না করে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই যুদ্ধও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অধিকারে বিশ্বাসী ইসলামের উদাহরণ।
এছাড়াও হুদায়বিয়ার সন্ধি হলো এক ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে নবী (সা.) যুদ্ধ এড়িয়ে কূটনৈতিক উপায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। হুদায়বিয়ার চুক্তি প্রথমে মুসলিমদের জন্য অসম মনে হলেও পরবর্তীতে এটি ইসলাম প্রচারের পথ সুগম করে। এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইসলামের প্রসার হয় মক্কার ভেতরেও।
তবে শুধু নবী (সা.)-এর যুগেই নয়, পরবর্তীতে খলিফা আলী (রা.)-এর শাসনামলে যখন বিদ্রোহ দেখা দেয়, তখনও ইসলামি নীতিমালার ভিত্তিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সে প্রতিরোধ কখনোই সাধারণ মানুষের উপর সহিংসতা বা নিপীড়নের মাধ্যমে হয়নি। বরং খলিফারা চেষ্টার কোনো কমতি রাখেননি যাতে অকারণে রক্তপাত না ঘটে।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবি-এর উদাহরণও এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তবে বিজয়ের পর তিনি প্রতিশোধ নেননি, বরং খ্রিস্টানদের জীবন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করেন, যা জিহাদের নৈতিকতা ও মানবিক দিকটি তুলে ধরে।
এর বিপরীতে, আধুনিক যুগে তথাকথিত ‘জিহাদি গোষ্ঠী’ যেমন আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি নিজেদের হিংস্র কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জিহাদের অপব্যাখ্যা ব্যবহার করে। অথচ তারা ইসলামের প্রাথমিক ঐতিহাসিক উদাহরণগুলো বা শান্তির নীতিগুলো একেবারেই অনুসরণ করে না।
ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত জিহাদ কখনোই সন্ত্রাস বা আগ্রাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এটি সর্বদা একটি ন্যায়ের সংগ্রাম, যার ভিত্তি হলো আত্মরক্ষা, নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া, এবং মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা।
ইসলামে জিহাদকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়
১. নিজের ইচ্ছাশক্তি, খারাপ অভ্যাস, অহংকার, লোভ, মন্দ চিন্তা ও পাপাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা। নিজের অন্তরকে শুদ্ধ করার এই সংগ্রাম একজন মুসলমানের জীবনের সর্বোচ্চ দায়িত্ব। পবিত্র হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “সব জিহাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জিহাদ হলো নিজের উপর যুদ্ধ”। অর্থাৎ, নিজের দুর্বলতা ও নৈতিক বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।
২. সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী প্রতিরক্ষা। ইসলামের শরীয়াহ আইন অনুসারে, যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে কঠোর শর্তাবলী মেনে চলতে হয়। যুদ্ধে নিরীহ মানুষ, নারী, শিশু, পবিত্র স্থান, গাছ-পাতা ও কৃষি ক্ষতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আগ্রাসন ও অবৈধ হিংসা ইসলামে হারাম। শুধু আত্মরক্ষার জন্যই যুদ্ধ করা যায়।
সন্ত্রাসবাদ হলো নিরীহ মানুষের উপর হামলা, হত্যা ও ভয়-ভীতি সৃষ্টি করার জন্য পরিকল্পিত হিংস্র কার্যক্রম। এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সুবিধা নেওয়া, সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে বিনষ্ট করা। সন্ত্রাসবাদ কোন ধর্মই অনুমোদন করে না। ইসলাম স্পষ্টভাবে নিরীহ মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করার নির্দেশ দেয়।
অন্যদিকে, জিহাদ হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, তবে সেটি শুধুমাত্র তখনই বৈধ যখন অন্যায় অত্যাচারী দ্বারা প্রথমে আক্রমণ করা হয়, নিরীহ মানুষদের ক্ষতি করা না হয়, শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থাকে, যুদ্ধের অন্যান্য ইসলামী বিধি ও নৈতিকতা অনুসরণ করা হয়।
তবে বহু সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ‘জিহাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে নিজেদের নির্মম কাজকে ধর্মীয় বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে, যা সম্পূর্ণ ভুল।
প্রথম ইসলামী যুগে, নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবারা শুধুমাত্র আত্মরক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছেন। কখনও তাদের নিজস্ব আগ্রাসন লক্ষ্য ছিল না। পাশাপাশি তারা সমাজে ন্যায় ও সঠিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলামী শাসকদেরও যুদ্ধের সময় নিরীহদের রক্ষা করা ছিল বাধ্যতামূলক।
তবে আধুনিক সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ‘জিহাদ’ শব্দটি অপব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন মতাদর্শী গোষ্ঠী নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ভুলভাবে এই শব্দটিকে ব্যবহার করছে, যা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ভুল ধারণা সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বের অনেক নামকরা ইসলামি পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, জিহাদ এক পবিত্র সংগ্রাম, যা মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ের জন্য করা হয়। অপরদিকে সন্ত্রাসবাদ কেবল হিংসা ও আতঙ্ক সৃষ্টি।
উদাহরণস্বরূপ, শাইখ ইউসুফ আল-কারদাউয়াহ বলেন, “জিহাদ হলো অন্যায় বিরুদ্ধে লড়াই, কিন্তু কখনই নিরীহদের ক্ষতি করা নয়। যারা নিরীহ মানুষের উপর হামলা করে, তারা ইসলামের শিক্ষার বিপরীত।”
বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশে জিহাদের প্রকৃত অর্থ ভুল বোঝার কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসবাদ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ইসলামি নেতাদের দায়িত্ব হবে ধর্মীয় শিক্ষার সঠিক প্রচার করা এবং সমাজকে ভুল তথ্য থেকে মুক্ত রাখা। একই সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিষয়টি বোঝা, যাতে মুসলিম সমাজের প্রতি মিথ্যা ধারনা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
সার্বিকভাবে বলা যায়, জিহাদ হলো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ ধারণা যা ন্যায়, শান্তি ও মানবিক মর্যাদা রক্ষায় সহায়ক। কিন্তু এর অপব্যবহার ও ভুল ব্যাখ্যা অনেকেই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত করে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অমানবিক।
ধর্ম কখনোই নিরীহ মানুষের উপর অন্যায় ও হিংসার আহ্বান জানায় না। আজকের বিশ্বে ইসলাম ও জিহাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ সুগম হয়।
আপনার মতামত জানানঃ