মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের তরুণ প্রীতম দাশের দুমাস আগের দেয়া পোস্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দিয়েছেন শ্রীমঙ্গল পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন। প্রীতম তার পোস্টে পাকিস্তানের দুর্দশার বিষয়ে দেশটির লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন।
শ্রীমঙ্গল পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন প্রীতমের ওই পোস্টের স্ক্রিনশট গত সোমবার ফেসবুকে শেয়ার করে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। তার ওই পোস্টের পর শ্রীমঙ্গলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রীতমের বিচার ও গ্রেপ্তার চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন অনেকে, যাদের বেশিরভাগই ছাত্রলীগের কর্মী। প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে গত বুধবার উপজেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে ‘শ্রীমঙ্গলের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা’। এ ঘটনায় স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আত্মগোপনে আছেন প্রীতম দাশ।
পাকিস্তানি লেখক সাদত হোসেন মান্টোর একটি উক্তি গত ৮ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রীতম। এর ঠিক আগের দিন ৭ জুলাই একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ‘নও পাকিস্তানি নও বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি লেখায় পাকিস্তানের দুর্দশার বর্ণনা করতে গিয়ে মান্টোর ওই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন।
সেই লেখা থেকে নেয়া মান্টোর উদ্ধতি নিয়ে পোস্ট দেয়ার প্রায় দুই মাস পর প্রীতমের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগ তোলেন আবেদ হোসেন।
মন্টোর উদ্ধৃতি নিয়ে গত ২৮ জুলাই সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ছেলে এবং মৌলভীবাজার-২ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম নাসের রহমান নামের ফেসবুক পেজ থেকেও একই স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল। তবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠেছে কেবল প্রীতমের বিরুদ্ধে।
ছাত্রলীগ নেতার স্ট্যাটাস
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদন হোসেন ২৯ আগস্ট নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দেন। ৮ জুলাই দেয়া প্রীতমের পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে এতে আবেদ লেখেন (বাক্য, বানান অপরিবর্তীত), ‘আমি তার ফেসবুকে ৭ জুলাইয়ের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট দিলাম যেখানে সে দেশের অবস্থা নাজেহাল বুঝাতে গিয়ে আমাদের ইসলাম ধর্মকে ব্যাঙ্গ করে উদাহরণ দিয়েছে, জুমার নামাজ, মুসজিদের ইমাম এবং মুসল্লীদের নামাজ পরাকে ব্যাঙ্গ করেছে।’
স্ট্যাটাসে আবেদ লেখেন, ‘আমি শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন ও শ্রীমঙ্গল থানার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই এ ধরণের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে যারা পবিত্র ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক কথা বলে তাদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে তারা কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে করতে চায় তা বের করা দরকার।‘
আবেদের এই স্ট্যাটাসের পর তার অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীসহ আরও অনেকে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এরপর বুধবার মিছিল হয় শ্রীমঙ্গলে। সেই মিছিল থেকে প্রীতমকে গ্রেপ্তারে শুক্রবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়।
কেন প্রীতমের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ
চা শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকায় প্রীতমের পুরনো একটি স্ট্যাটাস নিয়ে শ্রীমঙ্গলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে।
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ২৭ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে সমাবেশ করে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন। শ্রীমঙ্গলে চৌমোহনা চত্বরে আয়োজিত এ সমাবেশে হামলার ঘটনা ঘটে। আয়োজকরা প্রথম থেকেই অভিযোগ করছেন, স্থানীয় ছাত্রলীগের একটি অংশ এ হামলা চালায়।
প্রীতম দাশ ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। হামলার পর ২৯ ও ৩০ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে দুটি সংবাদ সম্মেলন করে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’। সেখানে লিখিত বক্তব্য পড়েন প্রীতম দাশ।
এতে তিনি অভিযোগ করেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেনের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা সমাবেশে হামলা চালায়। এতে প্রায় ১০ জন কর্মী আহত হন।
এই সংবাদ সম্মেলনের পরপরই ফেসবুকে ধর্ম অবমানননার অভিযোগ এনে প্রীতমের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেন আবেদসহ অন্যরা।
কী বলছেন প্রীতম দাশ
প্রীতম দাশ বলেন, ‘চা শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমাদের সমাবেশে আবেদের নেতৃত্বে হামলা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আমি তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছিলাম। সে কারণে সে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নামে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে উসকানি ছড়াচ্ছে।’
প্রীতম বলেন, ‘উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমি বাসায় যেতে পারছি না। আমার পরিবারও আতংকে আছে। পুরো উপজেলার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।‘
শ্রীমঙ্গলে উত্তেজনা
প্রীতম দাশের গ্রেপ্তার দাবিতে গত বুধবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল শহরে কলেজে রোডে ‘শ্রীমঙ্গলের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন ইকরামুল মুমিনিল ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের শ্রীমঙ্গল শাখার সভাপতি রহিম নোমানী।
রহিম নোমানী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘পাকিস্তানি লেখক কী লিখছেন সেটা পাকিস্তান বুঝবে। পাকিস্তানের বিষয় বাংলাদেশে টেনে আনা কেন?
‘শ্রীমঙ্গলে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি রয়েছে। একটি গোষ্ঠী এই সম্প্রীতি নষ্ট করতে ফেসবুকে অবমাননাকর কথা লিখেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শুক্রবার পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এর মধ্যে পুলিশ প্রীতমকে গ্রেপ্তার না করলে বা সে ক্ষমা না চাইলে আমরা নতুন কর্মসূচি দেব।’
অন্যদিকে সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কীম মনে করছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি ছড়াতেই একের পর এক এমন ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘হিন্দুরা কিছু বললেই বলা হচ্ছে ধর্ম অবমাননা হয়ে গেছে। মান্টোর উক্তি অনেকেই ব্যবহার করছেন। কেউ কখনও অবমাননার কথা বলেনি। আজ কেন বলা হচ্ছে। একটি হিন্দু ছেলে লিখেছে বলেই কি এটা হচ্ছে?
‘একটি গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারদলীয় অনুসারীরাও এতে পিছিয়ে নেই।’
তদন্ত করছে পুলিশ
শ্রীমঙ্গলে বর্তমানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। সংগঠনের সদ্যবিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ মনে করেন, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ফেসবুকে এ রকম উসকানি ছড়ানো উচিত নয়।
মাসুদ বলেন, ‘কেউ যদি ফেসবুকে খারাপ কিছু লিখে থাকে তবে পুলিশ আছে। এলাকার মুরব্বীরা আছেন। তারা বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু এ নিয়ে ফেসবুকে উসকানি দিয়ে উত্তেজনা ছড়ানো একেবারেই অনুচিত।
‘বিষয়টি মুখে মুখে অনেকের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে তা অত্যন্ত বাজে হবে।’
আবেদ হোসেন পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী বলে জানান মাসুদ। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সুব্রত পুরকায়স্ত বলেন, ‘আবেদ আমাদের সংগঠনের নেতা। তবে সে ফেসবুকে কী লিখেছে জানি না।’
ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম অর রশিদ তালুকদার বলেন, ‘একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে এলাকায় কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। আমরা সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগটিও তদন্ত করে দেখছি।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ