জর্জ ফ্লয়েডের স্মৃতি উসকে আমেরিকায় ফের আরেক কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করা হয়েছে। এবার পুলিশ ৬০টি গুলি চালিয়ে ওই যুবকের শরীর ঝাঁজরা করে দিয়েছে। স্থানীয় সময় গত সোমবার রাতে উত্তর-পূর্ব আমেরিকার ছোট্ট শহর অ্যাক্রনে এ ঘটনা ঘটে। সূত্র : আলজাজিরা, রয়টার্স।
সোমবার (২৭ জুন) রাতে ট্রাফিক আইন ভেঙে জেল্যান্ড ওয়াকার নামের ২৫ বছর বয়সী ওই যুবক দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে দাবি পুলিশের। পুলিশ তার পিছু নিয়ে গাড়ি থামাতে বলে। কিন্তু ওই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক গাড়ি না থামিয়ে গুলি ছোড়েন। তারপর গাড়ি থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন। পালানোর সময়ে ফের গুলি চালাতে পারেন এমন সন্দেহে পুলিশ গুলি চালায়। যদিও কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটির গুলি করার প্রমাণ দিতে পারেনি পুলিশ।
কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জেল্যান্ড পরিবারের আইনজীবী দাবি করেছেন, পুলিশ সেদিন প্রায় ৯০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল, যার মধ্যে অন্তত ৬০টি জেল্যান্ডের শরীরে ঢুকেছে। অসংখ্য গুলিতে তার মুখমণ্ডলও ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।
জানা গেছে, ঘটনাস্থলেই মারা যান ২৫ বছর বয়সী জেল্যান্ড ওয়াকার।
পেশায় ডেলিভারি বয় জেল্যান্ড শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের ছিলেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এবং তার প্রতিবেশী ও আত্মীয়রাও একই কথা জানিয়েছেন।
খবরে বলা হয়, কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল, বা পরেও গুলি চালানোর চেষ্টা করেছিল- এমন কোনো তথ্যই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল কি না- সে বিষয়েও পুলিশ নীরব। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে তাকে হত্যা করা হলো কেন?
পুলিশের বিবৃতি অনুয়ায়ী, ‘পালানোর সময় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আবারও গুলি চালাতে পারে সে। তাই আমরা গুলি চালাতে বাধ্য হই।’ কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা জানিয়েছেন, ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন জেল্যান্ড। তিনি শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের ছিলেন। যুবকটি যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল বা পরেও গুলি চালানোর চেষ্টা করেছিল তার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি পুলিশ।
এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতও দিতে পারেনি তারা। এ ছাড়া তার সঙ্গে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল কি না, সে বিষয়েও নীরব রয়েছে পুলিশ।এসব প্রশ্নের উত্তর না মেলায় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনেছে জেল্যান্ডের পরিবার।
কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল, বা পরেও গুলি চালানোর চেষ্টা করেছিল- এমন কোনো তথ্যই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল কি না- সে বিষয়েও পুলিশ নীরব। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে তাকে হত্যা করা হলো কেন?
এ ঘটনার পর উত্তাল অবস্থা চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। পুলিশের গুলিতে ফের কৃষ্ণাঙ্গর মৃত্যু নিয়ে কয়েক দিন ধরে ওহায়ো প্রদেশে বিক্ষোভ-সমাবেশ চলছে। রবিবারও অ্যাক্রনে একটি বড় আকারে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কায় পুলিশ সদর দফতরের সামনে বাড়তি কাঁটাতার ও ব্যারিকেড বসিয়ে রাখা হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শহরবাসীকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার ও মেয়র।
শহরবাসীকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে পুলিশ কমিশনার স্টিভ মাইলেট বলেছেন, ‘ঠিক কী ঘটেছিল, তা খতিয়ে দেখছি। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না। ’
একই বার্তা দিয়েছেন মেয়র ড্যান হরিগ্যান।
এদিকে স্বজনরা বডি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশের দাবি জানাচ্ছেন। এই মৃত্যুর ঘটনা এরই মধ্যে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষুব্ধরা বলছেন, জেল্যান্ড ও জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য একটাই, সেটা হলো পুলিশের হাঁটুর চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন জর্জ ফ্লয়েড, আর জেল্যান্ডকে মারা হয়েছে গুলি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের অত্যাচারে নিহত হিয়েছিলেন জর্জ ফ্লয়েড নামে এক ব্যক্তি। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, এই অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। বিশ্বব্যাপী নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছিল। সাজা হয় সেই পুলিশেরও, কিন্তু ঘটনার রেশ যেন এখনও কাটছে না।
দাসপ্রথা উচ্ছেদের দেড়শ’ বছরের বেশী সময় পেরিয়ে যাবার পরও যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষগুলোর ওপর সাদাদের নির্যাতন বন্ধ হয়নি। কাগজে কলমে সব ধরনের নাগরিক অধিকার পেলেও চরম বর্ণবাদ সঙ্কটের শিকার সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী।
গত কয়েক বছরে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহিংসতা বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার পর থেকে এই ধরনের সহিংসতার অনেক ঘটনা সামনে এসেছে। প্রবল প্রতিবাদও হয়েছে। তবু সহিংসতা থামছে না।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে ২০১৫ থেকে ২০২০ পাঁচ বছরে ১৩৫ জন নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
এনপিআর তাদের প্রতিবেদনে দেখায়, মোট ১৩৫ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৩০টির বিচার হয়েছে এবং ১৪২ মিলিয়ন ডলারের মতো অর্থদণ্ডের আদেশ জারি করা হয়েছে। কিছু কিছু মামলার শুনানি এখনো চলমান। এসব মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশী রেকর্ডের ‘হাজার হাজার পৃষ্ঠার’ তথ্য তাদের তদন্তকারী প্রতিবেদকরা নিরীক্ষণ করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটার সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০১
আপনার মতামত জানানঃ