সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, বা বলা যায় তাকে দমন করে রাখার জন্য দেশে অনেক আইন আগে থেকেই আছে; এরপরও নতুন নতুন আইন কানুন পাশ করার যে তোড়জোড় চলছে, তাতে কারও মনে হতে পারে সরকার যে খাতগুলোকে আটকে দেওয়া দরকার বলে ভাবছে, তার মধ্যে সবার আগে সাংবাদিকদের ‘স্থবির’ করা দরকার।
এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকেরা অন্যায় করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রেখে একটি আইন হচ্ছে। আইনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আছে। আগামী সংসদেই তা পাস হতে পারে। আজ মঙ্গলবার রাজশাহী সার্কিট হাউসে ‘প্রেস কাউন্সিল আইন ও আচরণবিধি এবং তথ্য অধিকার আইন অবহিতকরণ’ শীর্ষক সাংবাদিকদের দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক এ তথ্য জানিয়েছেন।
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বলেন, প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সাংবাদিকদের সম্মান দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, সাংবাদিকেরা এমন শ্রেণির লোক যাদের জন্য তিরস্কারই বড় শাস্তি। প্রেস কাউন্সিল আইনে কোনো অন্যায় করলে বেশির ভাগ সাংবাদিককেই তিরস্কার করা হয়ে থাকে। মানি লোকের জন্য তিরস্কারই বড় শাস্তি। এটা তাঁদের আত্মসম্মানে বাধবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন আইন প্রয়োজন হচ্ছে।
বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, ‘এখন যে কেউ সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁরা মানুষকে ব্ল্যাকমেল করছেন। সাংবাদিকতার নামে “সাংঘাতিকতা” চলছে। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অপমানজনক। এ কারণে সাংবাদিক কারা, তা নির্ধারণ করা যেমন জরুরি হয়ে পড়েছে, তেমনি নতুন আইনেরও দরকার হচ্ছে। আদার ব্যাপারীদের জন্য তো সাংবাদিকতা নয়। প্রকৃত সাংবাদিকদের জন্যই সাংবাদিকতা। এটাই এখন নিশ্চিত করার লক্ষ্য।’
নতুন আইন সম্পর্কে মো. নিজামুল হক বলেন, ‘কোনো সাংবাদিক অন্যায় করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে নতুন আইনে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এক দিনের জেলের পক্ষপাতী। জেলে গেলে তাঁর মনে হবে যে আমার কাজটা অন্যায় হয়েছিল। আর করা যাবে না। এই আইনটা কেবিনেটে আছে। আশা করছি, আগামী সংসদেই পাস হয়ে যাবে।’
সাংবাদিকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে জানিয়ে বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, এই কাজটা প্রেস কাউন্সিল ও পিআইবি যৌথভাবে করছে। পিআইবি ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকদের তালিকা করছে। আর প্রেস কাউন্সিল করবে প্রিন্ট মিডিয়ার। এ জন্য প্রতিটি প্রিন্ট পত্রিকা থেকে সাংবাদিকদের তালিকা নেওয়া হবে। তবে তালিকায় নাম থাকলেই সাংবাদিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। এটা যাচাই-বাছাই করা হবে।
বিচারপতি মো. নিজামুল হক আরও বলেন, নামিদামি অনেক পত্রিকার সম্পাদকের আত্মীয়রা সাংবাদিক পরিচয় দেন। তাঁরা তো আসলে সাংবাদিক নন, অন্য কাজ করে বেড়ান। এ রকম কেউ সাংবাদিক হিসেবে প্রেস কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত হতে পারবেন না। আর সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে গ্র্যাজুয়েশন। তবে কারও যদি নিয়োগপত্রসহ পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তিনি তালিকাভুক্ত হবেন। তালিকাভুক্ত হয়েই যে যা খুশি করবেন তা হবে না। প্রত্যেকের ছয় মাস পরপর কাজকর্ম ভেরিফিকেশন করা হবে।
বক্তব্য শেষে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী রাজশাহীর ৪৪ জন সাংবাদিকের হাতে সনদ তুলে দেন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রেস কাউন্সিলের সচিব মো. শাহ আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আশরাফুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিহা সুলতানা।
যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয় সাংবাদিকরা
বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে বিদ্যমান এমন কতকগুলো আইনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা- ১.) পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২.) ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩.) অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪.) আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫.) প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬.) প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭.) সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮.) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯.) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ১০.) ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১.) ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড্ সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২.) (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২।
মানহানির আইনটি যে কেবল অহরহ ব্যবহৃত হয়, তা-ই নয়; এই আইনটির অপব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। এই আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, শুধুমাত্র মানহানির শিকার হয়েছেন এমনটি মনে করা ব্যক্তিই এই আইনে মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং একাধিক মামলা দায়ের করা যাবে না। বাস্তবে দেখা যায় উল্টোটা। দেখা যাচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই যে কেউ এই ধরনের মামলা দায়ের করতে পারে এই দাবি করে যে, ‘আমার নেতার মানহানি হওয়ার কারণে আমার মানহানি হয়েছে।’ এই যুক্তিতে বা এই জাতীয় যুক্তিতে মামলার আবেদন করা হচ্ছে।
ট্র্যাজেডি হলো, নিম্ন আদালত এই সব মামলা গ্রহণ করছেন এবং একাধিক জায়গায় সেই মামলা নেওয়া হচ্ছে। ফলে সাংবাদিক/সম্পাদকদের দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজিরা দিতে এবং আদালতের শুনানিতে অংশ নিতে এবং জামিন চাইতে দেখা যায়। সৌভাগ্যবশত, মানহানির মামলার ঘটনা কমেছে। তবে এই গত পরশুও ভোরের কাগজের সম্পাদক এবং প্রকাশককে একটি সন্দেহজনক মানহানির মামলার শিকার হতে হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মুক্ত সংবাদমাধ্যমের ওপর এর বিধ্বংসী প্রভাব সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। এর ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো প্রতিদিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যা আমাদের সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের টিকে থাকার জন্য সেল্ফ-সেন্সরশিপ বা স্বনিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে বাধ্য করছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার বা বাতিল করার পক্ষে দেশের ৯৪ শতাংশ সাংবাদিক মত দিয়েছেন বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে, সাংবাদিক নির্যাতন কিংবা হয়রানির ৩০ শতাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা যুক্ত রয়েছেন।
গবেষণা ফলাফলে বলা হয়, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ এর বিভিন্ন অস্পষ্টতা দূর করে আইনটিকে অধিক গ্রহণযোগ্য করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? এর জবাবে ৯৪ শতাংশ সাংবাদিক আইনটি সংস্কার বা বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে ৬৫ শতাংশ মনে করেন, আইনটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তথ্য ও মতামত প্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য নেতিবাচক উপাদানগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনমাফিক সংস্কার করা প্রয়োজন, ২৯ শতাংশ সাংবাদিক আইনটি সম্পূর্ণ বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বাকিরা এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
দলীয় আলোচনায় উত্থাপিত নির্বাচিত আরও কয়েকটি আইন সম্পর্কে সাংবাদিকদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। কোন কোন আইন বা বিধি-বিধানকে আপনি সাংবাদিকতার জন্য সহায়ক মনে করেন বা সাংবাদিকতার জন্য বাধা হিসেবে বিবেচনা করেন? দেখা যায়, ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকতার জন্য সহায়ক নয়।
উত্তরদাতা ৪৬১ জন সাংবাদিকের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মনে করেন পেশাদার ও স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার জন্য একজন সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সংগঠন স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা বা চাপ সৃষ্টি করে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৮০ শতাংশ, ‘না’ বলেছেন ১০ শতাংশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসন স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কোনো চাপ বা বাধা সৃষ্টি করে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৬১ শতাংশ, ‘না’ উত্তর দিয়েছেন ২৩ শতাংশ। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা সৃষ্টি করে কি-না এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৭৯ শতাংশ, ‘না’ উত্তর এসেছে ১১ শতাংশের কাছ থেকে। তিনটি প্রশ্নে উত্তরদানে বাকিরা বিরত ছিলেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গবেষণার সময়সীমার মধ্যে ৪৪টি ঘটনায় ৬৭ জন সাংবাদিক আক্রমণ, মামলা, হয়রানি, হুমকি, নাজেহাল ইত্যাদির শিকার হয়েছেন। মোট ২৭টি জেলার পাঁচটি সিটি করপোরেশন ও ৩১টি উপজেলায় এসব ঘটনা সংঘটিত হয়।
ঘটনাগুলোর মধ্যে শারীরিক আক্রমণ ও নির্যাতন ৪৩ শতাংশ, মামলা ৩৬ শতাংশ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়া), হুমকি ১৪ শতাংশ ও হয়রানি ৫ শতাংশ। একটি ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহের সময় একজন সাংবাদিক নিহত হন (২ শতাংশ)।
ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা যুক্ত ছিলেন। ২৫ শতাংশের ঘটনায় অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ, যেমন- শিক্ষক, ঠিকাদার, প্রভাবশালী ইত্যাদির সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়। ১১ শতাংশ ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তা, ১১ শতাংশ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ৭ শতাংশ ঘটনায় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা যুক্ত ছিলেন। প্রকাশিত সংবাদ থেকে ১১টি ঘটনায় (১৬ শতাংশ) সংশ্লিষ্টদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাংবাদিকতা, তথ্য ও মতামত প্রকাশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কীভাবে প্রভাবিত করছে তা দেখার জন্য এ আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে অন্তত ২৫০টি মামলার সংবাদ সংগ্রহ করা হয়।
সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ঢাকা বিভাগে, ৮২টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ৫২, খুলনায় ২৮, সিলেটে ২৫, বরিশালে ২০ এবং রাজশাহীতে ১৫টি মামলা হয়। সবচেয়ে কম ১১টি মামলা হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭০৪
আপনার মতামত জানানঃ