নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যতে আনা এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত— দুই দেশই সম্মত হয়েছে কয়েক বছর আগে। এরপরও সেটা বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত ছয় বাংলাদেশির লাশ এখনও ফেরত পাননি স্বজনরা। দিন পেরিয়ে মাস, এর পর বছর গড়াতে শুরু করলেও মরদেহগুলো আনা হচ্ছে না। তবে আশা ছাড়েননি স্বজনরা। প্রিয়জনকে দেশের মাটিতে সমাহিত করতে চান তারা। তাই লাশ ফেরতের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন স্বজন ও স্থানীয়রা।
জাতীয় পত্রিকা সমকালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট জেলায় বিএসএফের গুলিতে গত বছরের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে নিহত ওই বাংলাদেশিদের লাশ ভারতের বিভিন্ন হিমঘরে পড়ে রয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে পাটগ্রাম সীমান্তে তিনজন, কালীগঞ্জ সীমান্তে দু’জন ও আদিতমারী সীমান্তে একজনের মৃত্যু হয়। ভারত লাশ ফেরত দিচ্ছে না, নাকি বিজিবি লাশ গ্রহণে তৎপরতা চালাচ্ছে না, তা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন আদিতমারীতে নিহত সাদ্দাম, ইদ্রিস আলী, আসাদুজ্জামান ভাসানী ও পাটগ্রামের ইউনুস আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের দুরবস্থা। এতদিনেও লাশ ফেরত না পেয়ে তারা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। আদৌ ফেরত পাবেন কিনা— সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মনে।
তাদের লাশ ফেরতের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিবির রংপুর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইয়াসির জাহান হোসেন বলেন, তাদের কাছে এ ধরনের তথ্য নেই। স্বজনদের কেউ সংশ্নিষ্ট থানা বা তাদের কাছে অভিযোগ জানায়নি।
এই হতভাগ্যদের মধ্যে সবার আগে নিহত হয়েছিলেন রিফাত হোসেন। গত বছরের ২৯ জুন পাটগ্রাম উপজেলার জগতবেড় ইউনিয়নের পূর্ব জগতবেড় সীমান্তে বিএসএফর গুলিতে মারা যান তিনি। রিফাত উপজেলার মুন্সিরহাট মোহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। লাশ ফেরত চেয়ে স্থানীয় সাংসদ ও বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দেন তার বাবা ইসমাইল হোসেন।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাবা হয়ে ছেলের লাশের জন্য অপেক্ষা করা খুবই বেদনাদায়ক। আর কাকে কীভাবে বললে লাশ ফেরত পাব আমরা?’
গত ১৪ জুলাই আদিতমারীর লোহাকুচি সীমান্তে বিএসএফর গুলিতে মারা যান সুবল চন্দ্র ওরফে সাদ্দাম। তিনি উপজেলার ভেলাবড়ি ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রামের বাসিন্দা।
সাদ্দামের স্ত্রী তরু বালা জানান, আট বছরের মেয়ে সোনালি তার বাবাকে ফেরত চেয়ে কান্নাকাটি করে। মেয়ের কান্না বুকের মধ্যে শেল হয়ে বিঁধে। উপার্জনের একমাত্র মানুষটিকে হারিয়ে পুরো পরিবার চরম আর্থিক কষ্টে পড়েছে।
গত ২৯ আগস্ট পাটগ্রামের বুড়িমারী বান্ধেরমাথা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে জগন্নাথ রায় সাগর এবং ইউনুস আলী মারা যান। ইউনুছ বুড়িমারী ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের আর নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বাসিন্দা সাগর।
ইউনুসের মা রাবেয়া বেগম জানান, তার পাঁচ বছরের নাতি আলিফ বাবাকে স্বপ্ন দেখে মাঝ রাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তার বাবা যেখানে নিখোঁজ হয়েছে সেই সীমান্তে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শিশুটি।
গত ১২ নভেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের বলায়ের হাট সীমান্তের বিএসএফের গুলিতে ইদ্রিস আলী (৫৫) ও আসাদুজ্জামান ভাসানী (৫০) নিহত হন। তারা দু’জনই গোড়ল ইউনিয়নের মালগাড়া গোড়ল গ্রামের বাসিন্দা।
ইদ্রিসের চার বছরের ছেলে সোয়াদ জানায়, সে বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়। পুলিশ হয়ে বাবার হত্যাকারীকে ধরবে সে।
ভাসানীর স্ত্রী মিনারা বেগম ও ছেলে মামুনুর রশিদ লাশ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তারা বলেন, শুনেছি ভারত সরকার লাশ দাফন করেছে।
‘বাবা হয়ে ছেলের লাশের জন্য অপেক্ষা করা খুবই বেদনাদায়ক। আর কাকে কীভাবে বললে লাশ ফেরত পাব আমরা?’
জানা গেছে, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় গরু আনতে সীমান্ত পার হয়েছিলেন ওই ছয়জন। পরে তারা বিএসএফের গুলিতে মারা যায়। তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ। এরপর থেকে আর কোনো খবর নেই তাদের। সাধারণত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করে থাকে। কিন্তু এই ছয়জনের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত যদিও বন্ধুরাষ্ট্র, তবুও এ দুই দেশের সীমান্তে রাষ্ট্রীয় হত্যা হয় গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে এই গুলির ঘটনা একতরফা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় কোনো নাগরিক গুলিবিদ্ধ না হলেও ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ম করেই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যাতে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিএসএফ আরও দাবি করেছে যে দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সদস্যরা গুলি চালায়। তবে কোনও অপরাধের সন্দেহে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হয় না।
এইচআরডাব্লিউ, অধিকার ও এএসকের প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, অপরাধী হিসেবে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিঠে গুলি করা হয়েছিল।
এইচআরডাব্লিউ আরও উল্লেখ করেছে, তদন্ত করা মামলার কোনোটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি যে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে; যার দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
সুতরাং, বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। ভারত সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান করছে এবং আইনের শাসন অনুসরণ করছে। বিএসএফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে জাতিসংঘের সাধারণ নীতিমালা মেনে চলার জন্য প্রকাশ্যে আদেশ দেওয়া উচিত। বিএসএফের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তার সদস্যদের বিচার করতে পারেনি। ভারত সরকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্যাতনের মামলাগুলো তদন্তের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল দফায় দফায় বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০১৮ সালে যেখানে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা ছিল ১১, সেখানে ২ বছরের ব্যবধানে তা চারগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৭
আপনার মতামত জানানঃ