বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের বাজার। এ যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নানামুখী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ইউক্রেন সংকটের কারণে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হবে। এতে করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য পাওয়া আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের ওপর প্রভাব’ সংক্রান্ত এ প্রতিবেদন বুধবার (২৭ এপ্রিল) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ যুদ্ধের প্রভাবে বাণিজ্য ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এছাড়া জাহাজ ভাড়া ও বীমা মাশুল বেড়ে যাওয়ায় টাকার অবমূল্যায়নের আশঙ্কাও রয়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ১২ ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা কূটনৈতিক নয়, মূলত অর্থনৈতিক সমস্যা। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি দেখছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বীমা মাশুল বেড়ে যেতে পারে। রফতানির পুরোটাই বাংলাদেশ এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে করে। ফলে রফতানির খরচ বাড়বে না। কিন্তু আমদানির বেশির ভাগই সিঅ্যান্ডএফ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট) ভিত্তিতে হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া বেড়ে আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে, যার প্রভাব পড়বে আমদানীকৃত পণ্যমূল্যে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে। এরই মধ্যে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৫৬১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি মুদ্রাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার আরো অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে।
চলতি অর্থবছরে রাশিয়া থেকে চার লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। আরো দেড়-দুই লাখ টন আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সূর্যমুখী ও তুলাবীজের সবচেয়ে বড় অংশ রাশিয়া থেকে আসে। রাশিয়া থেকে আমদানিতে অসুবিধা হলে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে বিশ্বে ৩০ শতাংশ গম সরবরাহ করে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানির ওপর মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি গম আমদানি না করলেও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ প্রভাবিত হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাশিয়ার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে রাশিয়ার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়— রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের রাশিয়ার ঋণ চুক্তির অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে আসে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ওই ঋণের অর্থ লেনদেনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ইউক্রেন সংকটের কারণে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান আফগান সংকটকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২সহ যেসব প্রকল্পের ব্যাপারে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়তে পারে।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের পর থেকে প্রতি বছরই রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার পরিমাণ কমছে। ২০২১ সালে ৯৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ অর্জিত হয়। ২০২০ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিংসঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ৮৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি মেলে ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের। এর আগের বছর ২০১৯ সালে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংকট মোকাবিলায় ৯২ কোটি ডলারের চাহিদা ছিল। ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয় ৬২ কোটি ডলার।
এর আগে ২০১৮ সালে ৯৫ কোটি ডলারের চাহিদার বিপরীতে সাড়ে ৬৫ কোটি ডলার পাওয়া গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি এসেছিল ২০১৭ সালে, মোট চাহিদার ৭৩ শতাংশ। সর্বশেষ চলতি বছর ৮৮ কোটি মার্কিন ডলার তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর গত বছরের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বেশি অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্নিষ্টদের।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সহায়তা এভাবে কমতে থাকায় সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যয় বেড়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়- যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়েছে। বাংলাদেশের রফতানির পুরোটাই এফওবি (প্রিন অন বোর্ড) ভিত্তিতে হওয়ার ফলে রফতানি খরচ বাড়বে। আর আমদানির বেশিরভাগই কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট ভিত্তিতে হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে। এতে আমদানি ব্যয় বাড়বে। বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে। চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঘটাতে পারে।
গত নয় বছরের মধ্যে তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠায় প্রতিদিন জ্বালানি তেল বাবদ সরকারকে ১৫ কোটি ডলার লোকসান দিতে হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে। এর প্রভাবে আমাদের পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও খরচ বাড়বে।
রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানিকারী ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কাতার, ওমান, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলির দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে বাংলাদেশের এলএনজির মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
ইউক্রেন সংকটের কারণে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হবে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমে যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ সহ যেসব প্রকল্পের বিষয়ে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মরণ স্বাক্ষরিত রয়েছে সেগুলো দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়তে পারে।
চলতি অর্থ বছরে রাশিয়া থেকে ৪ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। আরও দেড় থেকে দুই টন আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়াও বাংলাদেশে সূর্যমুখী ও তুলাবীজের বড় অংশ রাশিয়া থেকে আসে। রাশিয়া থেকে আমদানিতে অসুবিধা হলে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে বিশ্বে ৩০ শতাংশ গম সরবরাহ করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে গম আমদানির ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল। বাংলাদেশ দেশ দুটি থেকে খুব বেশি গম আমদানি না করলেও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ প্রভাবিত হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৮
আপনার মতামত জানানঃ