দশ বছর আগে সিদ্ধান্ত হয় ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক হবে তেল সমৃদ্ধ দেশ কাতার। সেই থেকেই চলছে আলোচনা। একে তো দেশটি বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্বটা বৈধ উপায়ে পায়নি বলে ইতিমধ্যেই প্রমাণ মিলেছে। ওদিকে দেশটি প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে বহু দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন।
এদিকে সম্প্রতি কাতারে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজে শ্রমিকদের জোর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেখেছে, কাতারে কাজ করা নিরাপত্তাকর্মী, যাদের মধ্যে ২০২২ বিশ্বকাপের প্রকল্পের লোকও আছেন, তারা যে পরিবেশে কাজ করেছেন, তা জোরপূর্বক শ্রমের পর্যায়ে পড়ে।’
নতুন প্রতিবেদনে এ সংস্থা জানিয়েছে, তারা কাতারে আটটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ৩৪ জন বর্তমান ও সাবেক কর্মীর অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করেছে, ‘নিরাপত্তাকর্মীরা, তারা সবাই অভিবাসী, জানিয়েছেন দিনে ১২ ঘণ্টা, সপ্তাহের সাত দিনই কাজ কাজ করতে হতো তাদের। প্রায়ই মাস এমনকি পুরো বছরও কোনো ছুটি ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছেন তারা।
অধিকাংশই বলেছেন, তাদের চাকরিদাতারা কাতারের আইন অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটি দিতে রাজি হতেন না এবং যে কর্মীরা ছুটি নিতেন, তাদের বেতন কেটে শাস্তি দেওয়া হতো। একজন কাতারে তার প্রথম বছরের বর্ণনায় বলেছেন, ‘যোগ্যরাই টিকে থাকে’।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আর্থিক ও সামাজিক বিচার বিভাগের প্রধান স্টেফান ককবার্ন বলেছেন, ‘আমরা যেসব অত্যাচার দেখেছি, এর পেছনে কাতারে অভিবাসী কর্মী ও চাকরিদাতাদের মধ্যে ক্ষমতার বিশাল পার্থক্যই প্রভাব ফেলেছে। এর অর্থ কর্তৃপক্ষ এখনো শ্রমিক আইন পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারেনি। আমরা যেসব নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সবাই জানতেন চাকরিদাতারা নিয়ম ভাঙছেন। কিন্তু এর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কর্মীরা প্রতিদিন কাজে হাজির হতেন। কারণ, তা না করলে তাদের আর্থিকভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। চুক্তি বাতিল বা দেশে ফেরত পাঠানোর ভয় তো আরও ভয়ংকর।’
‘গত কয়েক বছরে কাতার অনেক উন্নতি করেছে, কিন্তু আমাদের গবেষণায় আমরা অনেক অত্যাচারের নমুনা পেয়েছি। বিশ্বকাপের জন্য বেসরকারি খাতের চাহিদা অনেক বেড়েছে, আরও বাড়বে। চাকরিদাতারা এখনো প্রকাশ্যে শ্রমিকদের শোষণ করছে। কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। বিশ্বকাপ আর মাত্র কয়েক মাস দূরে, ফিফাকেও এমন অত্যাচার ঠেকাতে নজরদারি বাড়াতে হবে। না হলে এমন ঘটনা এ টুর্নামেন্টের গায়ে কালি লেপে দেবে।’
আর ফিফার উচিত তাদের শক্তি কাজে লাগিয়ে কাতারকে চাপ দেওয়া। যেন কাতার নিজেদের আইন আরও ভালোভাবে প্রয়োগ করে। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। এখনো যদি সঠিক চর্চা না করা হয়, ভক্তরা (বিশ্বকাপ দেখে) ঘরে ফেরার পরও অত্যাচার চলতে থাকবে।’
এ ব্যাপারে ফিফা বলেছে, কাতারে মানবাধিকার বিষয়ে অ্যামনেস্টির সঙ্গে বসবে তারা, ‘ফিফা বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে জড়িত কোনো প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের অত্যাচার মেনে নেবে না। ক্লাব বিশ্বকাপ ও আরব কাপের সময় যেসব ঠিকাদার সঠিক মান বজায় রেখে কাজ করতে পারেনি, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
দিনে ১২ ঘণ্টা, সপ্তাহের সাত দিনই কাজ কাজ করতে হতো তাদের। প্রায়ই মাস এমনকি পুরো বছরও কোনো ছুটি ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছেন তারা।
এর আগে ইংলিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান তাদের বিশেষ প্রতিবেদনে বলেছিল যে, বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার পর এর প্রস্তুতিতে সেখানে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি দক্ষিণ এশিয়ান শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বিশ্বকাপ আয়োজনের গৌরব অর্জনের পর থেকে কাতারে প্রতি সপ্তাহে গড়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তান বাদে ৪টি দেশে গার্ডিয়ানের নির্ভরযোগ্য সূত্র ও দেশগুলোর সরকারি হিসাবই বলছে—২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৫ হাজার ৯২৭ জন প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মৃত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজার ১৮। কাতারে পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে ৮২৪ জন পাকিস্তানি শ্রমিক মারা গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর হিসেবই দেয়া হয়েছে। তবে সেখানে ফিলিপাইন ও কেনিয়াসহ বিশ্বের আরো অনেক দরিদ্র দেশ থেকে মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। আবার এই হিসেবে গত বছরের শেষ দিকে মৃত্যুর সংখ্যা যুক্ত করা হয়নি।
স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজে জড়িত শ্রমিকদের মৃত্যুর ব্যাপারে গার্ডিয়ান কথা বলেছিল দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে। তারা বলেছেন, আমরা এসব ঘটনায় গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি এবং সব ক্ষেত্রেই তদন্ত করেছি, যেন এ থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। আমরা এ বিষয়ে বরাবর স্বচ্ছতা বজায় রেখেছি এবং আমাদের প্রকল্পে মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভুল যে দাবিগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর প্রতিবাদ করেছি।
এ ব্যাপারে বিশ্ব ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ও কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা ফিফা এ ব্যাপারে জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে যত নির্মাণকাজ হচ্ছে, সে তুলনায় ফিফা বিশ্বকাপের নির্মাণকাজে দুর্ঘটনার হার বেশ কম। কারণ, এখানে খুব গুরুত্বের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তার বিষয়টা মানা হয়।
১০ বছর আগে কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়। এরপর থেকেই দেশটি বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তৈরি হয় অসংখ্য ভবন। সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতেও স্থাপিত হয় নানা স্থাপনা। ফুটবলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত স্থাপনাও রয়েছে এরমধ্যে। তৈরি হয়েছে ৭টি ফুটবল স্টেডিয়াম। এছাড়া নতুন বিমানবন্দর, রাস্তা, গণ-পরিবহণ, হোটেল ও নতুন একটি শহরও তৈরি করা হয়েছে। সবই বিশ্বকাপকে সামনে রেখে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৭
আপনার মতামত জানানঃ