ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে চলমান যুদ্ধে শত শত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারী ও মেয়েদের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধনে সেখানে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ টাইগ্রিয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) সঙ্গে সম্পৃক্ত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ইথিওপিয়ার আমহারা অঞ্চলে গণধর্ষণ ও হামলাসহ নৃশংসতার অভিযোগ এনেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইথিওপিয়ার সশস্ত্র সংগঠন টিপিএলএফ ইচ্ছাকৃতভাবে ডজনখানেক মানুষকে হত্যা করেছে এবং কয়েক ডজন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করেছে, যাদের বয়স ১৪ বছরের নিচে। এ ছাড়া সংগঠনটির যোদ্ধারা আমহারা অঞ্চলের দুটি এলাকায় ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তি লুট করেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের জুলাই মাসে টাইগ্রিয়ান যোদ্ধারা আমহারা অঞ্চলের দুটি এলাকা দখল করে। সে সময় কোবো শহরে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষদের হত্যা করেছে। নারী ও শিশুদের গণধর্ষণ করেছে।
প্রায় ২৭ জন সাক্ষী ও ঘটনাস্থল থেকে বেঁচে ফেরাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, অনেককেই মাথায় গুলি করে, বুকে গুলি করে এবং অনেককে পেছন থেকে দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, টিপিএলএফকে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে বলা হলে তারা সাড়া দেয়নি।
ঘটনাস্থল থেকে বেঁচে ফেরা অনেকেই দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন। যেসব ডাক্তার এই নারীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন তারা জানিয়েছেন, দুজন নারীর জেনিটাল অর্গানে তারা বেয়নেটের আঘাতের ক্ষত পেয়েছেন।
আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে সংঘাত চলছে এবং এই সংঘাত ২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রতিবেশী আমহারা ও আফার অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে৷ শুধু টাইগ্রিয়ান নয়, সংঘাতের সব পক্ষের বিরুদ্ধে নৃশংসতা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে টাইগ্রিয়ান যোদ্ধারা আমহারা অঞ্চলের দুটি এলাকা দখল করে। সে সময় কোবো শহরে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষদের হত্যা করেছে। নারী ও শিশুদের গণধর্ষণ করেছে।
২০২০ সালের নভেম্বরে ইথিওপিয়ার সরকার টাইগ্রে অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেওয়া টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রতিবেশী দেশ ইরিত্রিয়াও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে সেখানে এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র যুদ্ধের জন্য প্রায় তিন লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। শরণার্থী শিবিরেও হামলা চালানো হয়েছে। তীব্র অনাহার শুরু হয়েছে ইথিওপিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এর মধ্যে যদি ফের লড়াই শুরু হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরো খারাপ হবে।
সাম্প্রতিক সংঘাতের জের ধরে ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। এ কারণে তীব্র খাদ্যাভাবে পড়েছে সেখানকার চার লাখের বেশি মানুষ। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আট কয়েক ধরে চলছে এ সংঘর্ষ। আরও ১৮ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানান। এ ছাড়া সংঘাতের কারণে কমবেশি ৩৩ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে বলে নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে তথ্য দেওয়া হয়।
টাইগ্রের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির নাটকীয় অবনতি হয়েছে বলে নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রমেশ রাজাসিংঘাম। তিনি বলেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে এই অঞ্চল সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখছে। সেখানে প্রায় ৫২ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
এর আগে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, ইথিওপিয়ার সংঘাতপূর্ণ টাইগ্রে অঞ্চলে অপুষ্টির শিকার অন্তত ১ লাখ শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে আছে।
জরুরি সহায়তা না পেলে আগামী এক বছরের মধ্যে এসব শিশুর মৃত্যু হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। টাইগ্রে অঞ্চলে পরিদর্শন শেষে ফিরে এসে জেনেভায় সংস্থার মুখপাত্র মারিশি মারকাদো বলেন, ‘দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাটিতে প্রতি দু’জনের একজন গর্ভবতী নারী ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার।’
মারিশি আরও বলেন, সহিংস এলাকাটিতে অসংখ্য নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
জুন মাসে, টাইগ্রে যোদ্ধারা এই অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করে এবং ইথিওপিয়া সরকার মানবিক কারণ দেখিয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও, তারা এই অঞ্চলটিকে আগের চেয়ে কঠোরভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, মানবিক সাহায্য টাইগ্রেতে বাহিনীর কাছে পৌঁছাবে।
সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি খাদ্য সহায়তা ইথিওপিয়ায় অবস্থান করলেও, এর খুব সামান্যই টাইগ্রেতে প্রবেশ করতে পারে। সরকার এতটাই সতর্ক যে এই অঞ্চলে কদাচিৎ ফ্লাইটে আরোহণকারী মানবিক কর্মীদের এমন সব জিনিসের অস্বাভাবিক তালিকা দেওয়া হয়েছে যা তারা আনতে পারে না: যেমন ডেন্টাল ফ্লস, ক্যান ওপেনার, মাল্টিভিটামিন, ওষুধ, এমনকি ব্যক্তিগত ওষুধ।
বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, সেখানে সংকটের চিত্র ধারণ একেবারেই নিষিদ্ধ, এমনকি হার্ডড্রাইভ কিংবা ফ্ল্যাশ ড্রাইভও বহন করা বারণ। জুন থেকে টাইগ্রেতে ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কারণ সাহায্যকর্মী এবং অন্যদের কর্তৃপক্ষের তীব্র অনুসন্ধানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তাদের সাথে থাকা ডিভাইস ধরা পড়ার আশঙ্কায় আছে তারা। টাইগ্রেতে অন্ধকার বিরাজ করছে। কোন টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, ব্যাংকিং সেবা নেই। আছে খুব সামান্য কিছু সাহায্য।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অস্বীকার করেছেন যে টাইগ্রেতে ক্ষুধা রয়েছে। সরকার সাহায্য বিতরণে সমস্যার জন্য টাইগ্রেতে বাহিনী এবং নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেছে। এছাড়া তারা মানবতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে টাইগ্রেতে যোদ্ধাদের সমর্থন করার, এমনকি অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগও করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ