সাম্প্রতিক সংঘাতের জের ধরে ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। এ কারণে তীব্র খাদ্যাভাবে পড়েছে সেখানকার লাখ লাখ মানুষ। ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলের কিছু অংশে মানুষ এখন দিনের পর দিন শুধু সবুজ পাতা খেয়ে বেঁচে আছে। গত সপ্তাহে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, একজন মা এবং তার মাত্র ১.৭ পাউন্ড ওজনের নবজাতক ক্ষুধায় মারা যায়। ২০টিরও বেশি জেলায় যেখানে মাত্র একটি সাহায্য গোষ্ঠী কাজ করছে, সেখানকার বাসিন্দারা অনাহারে মারা যাচ্ছে। খবর এপি, আল জাজিরা
বিদ্রোহী গোষ্ঠী টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএরএফ) ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘাতে এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে খবর মিলেছে। ঘরছাড়া হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। সংঘাতে সরকার ও বিদ্রোহী দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
ইথিওপিয়ার এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে টিপিএলএফের নেতৃত্বে ইথিওপিয়া থেকে সামরিক সরকার উৎখাত করা হয়। এরপর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আবি আহমেদ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগপর্যন্ত দেশটির রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ছিল এই গোষ্ঠীর হাতে। কিন্তু গত বছর ইথিওপিয়ার ফেডারেল সেনাবাহিনী এবং টিপিএলএফ-এর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
এই সংঘর্ষের জেরে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সেখান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর মার্ক লোকক বলেন, সেখান এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
জাতিসংঘের ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, ইথিওপিয়ার ওই টাইগ্রে অঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ‘ভয়ংকর সংকটের’ মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী আমহারা ও আফার এলাকার পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম।
টাইগ্রে অঞ্চলে সংঘর্ষ শুরুর পর সেখানে কোনো সাহায্য সংস্থাকে ঢুকতে দিতে চাইছিল না আবি আহমেদের সরকার। জাতিসংঘের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সেখানকার খাদ্যসংকট ‘বিপর্যয়ের’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেখানকার মানুষ অনাহারে থাকছে, মারা যাচ্ছে।
কয়েক মাস ধরে জাতিসংঘ উত্তর ইথিওপিয়ার এই উত্তাল কোণে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করে এটিকে এক দশকের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ক্ষুধা সংকট বলে অভিহিত করেছে। ইথিওপিয়ার সরকার সেখানে জুন মাসে জাতিসংঘের ভাষায় “কার্যতঃ মানবিক সহায়তা অবরোধ” আরোপ করে, সে সময় থেকে ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যুর বিবরণ এখন অভ্যন্তরীণ নথিপত্র এবং সাক্ষীদের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে।
ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলের আঠারো মাস বয়সী শিশু হাফটম হাইলে। ঠিকমতো কাঁদতেও পারছে না সে। খাবারের জন্য কাঁদতে যে শক্তিটুকু প্রয়োজন, সেটাও নেই তার শরীরে। ছোট্ট হাফটমের মা গিরমানেশ মেলেস নিজেও অপুষ্টিতে ভুগছেন। এক মাস হলো খাবার শেষ। এখন সন্তানের জন্য বুকের দুধটুকুও নেই তার। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর চলমান সংঘাতের ১০ মাস কেটে গেলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এ অঞ্চলে। জুলাইয়ের প্রথম ভাগে শুরু হওয়া এ সংকট আগে শুধু টাইগ্রের গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা পৌঁছে গেছে মেকেল পর্যন্ত।
মেলেস জানান, এক মাস হলো সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন চার-পাঁচ দিন না খেয়ে থাকাটাও স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতো অনেকেই এখন বেঁচে আছেন আত্মীয়-স্বজনদের দান করা সামান্য পরিমাণ খাবার খেয়েই। তিনি জানান, দুই সপ্তাহ আমি গ্রামেই ছিলাম। ভেবেছিলাম, কেউ না কেউ তো সাহায্য করবে। কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। সবার অবস্থাই আমাদের মতো।
কয়েক মাস ধরে জাতিসংঘ উত্তর ইথিওপিয়ার এই উত্তাল কোণে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করে এটিকে এক দশকের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ক্ষুধা সংকট বলে অভিহিত করেছে।
খাবার না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুসন্তানকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত চলতি মাসের ১১ তারিখ আরাগুর থেকে হেঁটেই মেকেলের টাইগ্রে ফ্ল্যাগশিপ আইডার রেফারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন মেলেস। জানান, আমার আত্মীয়রা আমাকে গ্রামেই থাকতে বলেছিল। বলেছিল, হাসপাতালের করার কিছুই নেই। কিন্তু দিনদিন চোখের সামনে আমার সন্তান রুগ্ন আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মা হয়ে চোখের সামনে আমি বসে বসে সন্তানের মরে যাওয়া দেখতে পারি না।
আইডার হাসপাতালের কর্মরত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্রা গেব্রেগজাব জানান, গত দুই মাসের মেকেলের প্রধান হাসপাতালগুলোতে গুরুতর অপুষ্টিতে ভোগা ৬০ শিশু এসেছে। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৬ শিশু।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর চলমান সংঘাতের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে চার লাখের বেশি মানুষ বিপদগ্রস্ত রয়েছে। দুর্ভিক্ষের ফলে অন্তত ৩৩ হাজার শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এ ছাড়া আট মাসের এই সংঘাতে আরো ১৮ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে ইথিওপিয়ায়। প্রায় ৫২ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
জুন মাসে, টাইগ্রে যোদ্ধারা এই অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করে এবং ইথিওপিয়া সরকার মানবিক কারণ দেখিয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও, তারা এই অঞ্চলটিকে আগের চেয়ে কঠোরভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, মানবিক সাহায্য টাইগ্রেতে বাহিনীর কাছে পৌঁছাবে।
সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি খাদ্য সহায়তা ইথিওপিয়ায় অবস্থান করলেও, এর খুব সামান্যই টাইগ্রেতে প্রবেশ করতে পারে। সরকার এতটাই সতর্ক যে এই অঞ্চলে কদাচিৎ ফ্লাইটে আরোহণকারী মানবিক কর্মীদের এমন সব জিনিসের অস্বাভাবিক তালিকা দেওয়া হয়েছে যা তারা আনতে পারে না: যেমন ডেন্টাল ফ্লস, ক্যান ওপেনার, মাল্টিভিটামিন, ওষুধ, এমনকি ব্যক্তিগত ওষুধ।
বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, সেখানে সংকটের চিত্র ধারণ একেবারেই নিষিদ্ধ, এমনকি হার্ডড্রাইভ কিংবা ফ্ল্যাশ ড্রাইভও বহন করা বারণ। জুন থেকে টাইগ্রেতে ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কারণ সাহায্যকর্মী এবং অন্যদের কর্তৃপক্ষের তীব্র অনুসন্ধানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তাদের সাথে থাকা ডিভাইস ধরা পড়ার আশঙ্কায় আছে তারা। টাইগ্রেতে অন্ধকার বিরাজ করছে। কোন টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, ব্যাংকিং সেবা নেই। আছে খুব সামান্য কিছু সাহায্য।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অস্বীকার করেছেন যে টাইগ্রেতে ক্ষুধা রয়েছে। সরকার সাহায্য বিতরণে সমস্যার জন্য টাইগ্রেতে বাহিনী এবং নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেছে। এছাড়া তারা মানবতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে টাইগ্রেতে যোদ্ধাদের সমর্থন করার, এমনকি অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগও করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪১
আপনার মতামত জানানঃ