গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত ইথিওপিয়া। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের নেতৃত্বে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই চালাচ্ছে তাইগ্রে বিদ্রোহীরা। ক্রমে রাজধানী আদিস আবাবার দিকে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে আসছে তারা। জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। জরুরি অবস্থার ফলে রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহণ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। সামরিক বাহিনী যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সেসব এলাকায় কারফিউ জারি রয়েছে।
ঘর থেকে বের হলেই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হচ্ছে দেশটির নাগরিকরা। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কারও সম্পৃক্ততার সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে আটক করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে টিগ্রের হাসপাতালে অনাহারে একের পর এক শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে।
অনাহারে শিশু মৃত্যু
ইথিওপিয়ার সংঘাতপূর্ণ টাইগ্রে অঞ্চলে মানবিক সহায়তা বন্ধের কারণে না খেয়ে মারা যেতে পারে হাজার হাজার মানুষ। চলতি বছরের শুরুতেই ভয়াবহ এই শঙ্কার কথা জানিয়েছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রেড ক্রস। টাইগ্রেতে বসবাসকৃত কমপক্ষে ৩৮ লাখ মানুষের জন্য জরুরি মানবিক ও খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন বলে জানায় তারা।
এরপর জাতিসংঘের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য; ইথিওপিয়ার যুদ্ধপ্রবণ টাইগ্রে অঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। পরে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থা ইউএনওসিএইচএ-এর প্রধান মার্ক লোকক বলেন, এ দুর্ভিক্ষ আরও প্রকোট আকার ধারণ করবে। ছড়িয়ে পড়তে পারে পার্শ্ববর্তী আমহার ও আফার এলাকায়।
বর্তমানে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত দেশটি। কারণ না দেখিয়ে জাতিসংঘের একাধিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ইথিওপিয়ার প্রশাসন। সম্প্রতি জাতিসংঘ ইথিওপিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তা উদ্বেগজনক। বলা হয়েছে, কোনো কারণ না দেখিয়ে হাজারেরও বেশি টিগ্রের মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতিসংঘের ৩৫ জন স্থানীয় কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে জাতিসংঘে কাজ করা একাধিক গাড়ির চালককে। কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা বলা হয়নি।
বস্তুত, ইথিওপিয়ার আইন অনুযায়ী, যতদিন জরুরি অবস্থা থাকবে, ততদিন কারণ না দেখিয়ে সকলকে জেলে ভরে রাখা যাবে। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। টিগ্রেতে কার্যত অর্থনৈতিক ব্লকেড তৈরি করা হয়েছে। ফলে অনাহারে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্তত দেড়শ শিশুর মৃত্যু হয়েছে টিগ্রের হাসপাতালে। সকলেরই বয়স পাঁচ বছরের কম। অনাহারে আরো বহু শিশু হাসপাতালে ভর্তি। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, দেড়শর অনেক বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে গত কিছুদিনে।
টিপিএলএফ এবং ইথিওপিয়ার সরকার এখনো পর্যন্ত আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। তবে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলি তাদের আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলিও একই অনুরোধ করেছে। গত এক বছরে কয়েক লাখ মানুষ টিগ্রে ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে অনাহার এখন টিগ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে আছে ইথিওপিয়া। টিগ্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) সঙ্গে লাগাতার লড়াই হয়েছে ইথিওপিয়ার সেনার। টিগ্রে আগেই দখল করে নিয়েছিল টিপিএলএফ। এখন তারা রাজধানীর কাছে পৌঁছে গেছে। যার জেরে ইথিওপিয়াতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সরকার।
গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইথিওপিয়া
রাজধানী থেকে সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দূরের শহর দখল করে নিয়েছে টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্স (টিপিএলএফ)। তারপর তারা রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে। এর আগে তারা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে টিগ্রের দখল নিয়েছিল। উপরের ছবিটি টিগ্রের রাজধানী দখলের পর টিপিএলএফের সদস্যদের।
রাজধানী আদ্দিস আবাবায় সরকার ও সেনার সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ মানুষ। বিশাল জমায়েতে তারা সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিদ্রোহী টিপিএলএফ-কে ঠেকাতে না পারলে তারা রাজধানীর দখল নিয়ে নেবে। তখন রক্তগঙ্গা বইতে পারে। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও বাড়বে।
সরকার ইতিমধ্যেই সাবেক সেনা অফিসার ও জওয়ানদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করার অনুরোধ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ, সাধারণ মানুষও যেন হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং দেশরক্ষার জন্য এগিয়ে আসে। কার কাছে কী অস্ত্র আছে, তাও নথিভুক্ত করা হচ্ছে।
এমনকি সাবেক সেনাকর্তা বর্তমান সেনার সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। তিনি ও বর্তমান সেনাপ্রধান সংঘর্ষে নিহত সেনার উদ্দেশ্যে শোকপ্রকাশ করছেন। টিপিএলএফের হাতে যেসব সেনার মৃত্যু হয়েছে, তাদের স্মরণে মোমবাতি মিছিল আদ্দিস আবাবায়। প্রচুর মানুষ এভাবে শোকপ্রকাশ করেছেন।
আমহারা অঞ্চলে বিদ্রোহীরা একটি শহর দখল করে নিয়েছে। অক্টোবরে এই শহর সেনার হাতছাড়া হয়। যেভাবে এখন টিপিএলএফ এবং আমহারা ফোর্স সেনাকে পরাস্ত করে এগিয়ে আসছে, তাতে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। প্রশ্ন এখন রাজধানীর দখল কে নিজের কাছে রাখতে পারবে তা নিয়ে। ফলে গভীর সংকটের মুখে পড়েছে ইথিওপিয়া।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪২
আপনার মতামত জানানঃ