ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ইতোমধ্যে খাদ্য সংকটের সতর্কতা জারি করেছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে দুর্ভিক্ষ। সেখানে প্রতিদিন শতাধিক শিশু মারা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চলগুলো যদি জরুরি সাহায্য না পায় তাহলে অনাহারে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে৷ শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ তাদের মায়ের পুষ্টিহীনতা ও খাদ্যের অভাব।
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের তৎপরতার কারণে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে সোমালিয়ায়। গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন শহরের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
হালিমা হাসান আবদুল্লাহির পরিবারও তেমনি একটি বাস্তুচ্যুত পরিবার। মাস দেড়েক আগে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ডলো শহরে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন হালিমা ও তার পরিবারের সদস্যরা।
হালিমা হাসান আবদুল্লাহির দুই জমজ নাতনি এবলা ও আবদিয়ার কবরে এখনও রয়েছে কাঁটা গাছের ডালপালা। এক মাস আগে জন্ম নেওয়ার পর মাত্র একদিন বেঁচেছিল এবলা-আবদিয়া। তার পরই তাদের মৃত্যু হয়।
এই শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ তাদের মায়ের পুষ্টিহীনতা ও খাদ্যের অভাব। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে হালিমা বলেন, ‘বাচ্চা দু’টির জন্মের সময় তাদের মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল, আমার নাতনিদের মৃত্যুর মূল কারণ ক্ষুধা।’
এই সদস্যদের মধ্যে তার গর্ভবতী পুত্রবধুও ছিলেন। খাদ্যপণ্যের সংকট ও খাবারের মূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে গর্ভাবস্থায়ও খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন হালিমার পুত্রবধু। তার পরিণতিতেই দুর্বল দুই শিশুর জন্ম দেন তিনি, যারা জন্মের পর বেঁচে ছিল মাত্র এক দিন।
ডলো শহরের যে ক্যাম্পটিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি মাথা তুলেছে চলতি বছর জানুয়ারিতে। প্রায় ১৩ হাজার মানুষ বসবাস করেন এই শিবিরে।
সোমালিয়ায় টানা চার বছর ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। হলেও একেবারে কম। দেশটির আবহাওয়াবিদদের মতে, গত ৪০ বছরে এমন ভয়াবহ খরা দেখেনি সোমালিয়া। পানির অভাবে দেশটির কৃষি ব্যাবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু মৃত্যুও হয়েছে এই খরার কারণে। গৃহযুদ্ধ ও খরাজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে সোমালিয়ার বিভিন্ন শহরে বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৬০ লাখ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন তাদের।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। গোটা বিশ্বের মনযোগ এখন ইউক্রেনের দিকে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও জাতিসংঘ সোমালিয়ার দুর্গতদের জন্য বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে সোমালিয়ায় খাদ্য সংকটজনিত কারণে যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে দেশটির ২০১১ সালের মহা দুর্ভিক্ষের তুলনা করা চলে। ওই দুর্ভিক্ষে সোমালিয়ায় আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং তাদের অধিকাংশই ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
‘বাচ্চা দু’টির জন্মের সময় তাদের মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল, আমার নাতনিদের মৃত্যুর মূল কারণ ক্ষুধা।’
জাতিসংঘ অবশ্য ইতোমধ্যে সোমালিয়ার দুর্গত লোকজনের জন্য কিছু আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই তহবিলের মাত্র ১৫ শতাংশ পৌঁছেছে দেশটিতে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত ২৮ লাখ দুর্গত মানুষ সেই তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েচেন, আর এখনও কোনো সহায়তা পাননি অন্তত ৩১ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সোমালিয়ার ৬ টি এলাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষ খরার কারণে ব্যাপক সংকটে পড়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে থাকেন, বাকিরা থাকেন দেশটির অন্যান্য দুর্গম অঞ্চলে। সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে জঙ্গি গোষ্ঠী আল শাবাব।
উদ্বাস্তু শিবিরে লোকজন ঘর বানিয়েছে লাঠির কাঠামোর ওপর কমলা রঙের তেরপল, প্লাস্টিক ও টুকরো কাপড় দিয়ে। সরেজমিনে এসব ত্রাণ শিবির ঘুরে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে, করোগেটেড টিন দিয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য টয়লেট বানানো হচ্ছে, বহু ত্রাণ শিবিরের সামনেই ভিড় করছেন শহরে নতুন আসা উদ্বাস্তুরা, কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ত্রাণ শিবিরের লোকজন।
সাহায্যের পরিবর্তে অনেক পরিবার এক মুঠো খাবার কিংবা সামান্য কিছু পয়সা ভিক্ষাও চাইছে, কিন্তু তাও মিলছে না ঠিকমতো। ক্ষুধা-অপুষ্টির পাশাপাশি রোগে ভুগেই ত্রান শিবিরে মারা যাচ্ছে অনেক শিশু।
জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে, সংঘাতে বিপর্যস্ত সোমালিয়ায় খরার কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। সেখানে বিগত তিন ঋতু কম বৃষ্টিপাতের পরে চতুর্থ দফা বৃষ্টিপাত কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলেছে, বিগত ৩০ বছরে দেশটিতে কখনো টানা তৃতীয়বার বৃষ্টিহীন বর্ষাকাল দেখা যায়নি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সংঘাত নয় বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সোমালিয়ায় বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সোমালিয়া সংক্রান্ত জাতিসংঘ মানবিক সমন্বয়ক অ্যাডাম আবদেলমৌলা এক সাক্ষাৎকারে এএফপিকে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী ৩ লাখ শিশু গুরুতর অপুষ্টির ঝুঁকিতে পড়বে।
আফ্রিকার ছোট্ট দেশ সোমালিয়া। কিছুটা প্রাকৃতিক হলেও দেশটিতে দুর্ভিক্ষের অধিকাংশই মানবসৃষ্ট। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই জাতি ও অঞ্চলগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে দেশটি। ফলে সরকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কোনো কাজ বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ত্রাণ নিয়ে বেশ কিছু অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।
আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি এখনো স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারেনি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়েছে। এমনকিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এখন পর্যন্ত। সামান্য কলেরায় হাজারো শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। জীবন মান উন্নয়ন ও শিক্ষার কোনো উদ্যোগ কাজে লাগতে পারেনি দেশটির সরকার। সে দেশের সেনাবাহিনী পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরাপত্তার কারণে সব অঞ্চলে যেতে পারে না।
সর্বশেষ ২০১১ সালে সংগঠিত দুর্ভিক্ষে ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা দেয়ার আগেই অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়। যার অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। বর্তমানে দেশটির প্রায় জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বা ৩০ লাখ লোক খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে।
দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জাতিসংঘ দেখতে পায়, মূলত অভ্যন্তরীণ জাতিগত যুদ্ধে দেশটির নিরাপত্তা সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এলাকায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া সম্ভব হয়নি। অনেক অঞ্চলে ত্রাণ ও সাহায্য নিয়ে কর্মীদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। এসব কারণে সেই দুর্ভিক্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ