সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের দশম বার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের এই দিনে (১১ ফেব্রুয়ারি) মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সারোয়ার ওরফে সাগর সারোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। এই হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন।
সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তারা বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হবে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে সাড়ে ৮৭ হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এত সময়ে মামলার বিচারই শুরু করা যায়নি।
এতো বছরেও এই হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কাজ শেষ হয়নি। বিগত ১০ বছরে ৮৫ বার সময় নিয়েও আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মামলাটির তদন্ত শেষ হওয়ার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে ফরেনসিক ও ডিএনএ রিপোর্টের ওপর। ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই দুই পরীক্ষার প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত শেষ হবে না তদন্ত।
এদিকে আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জানুয়ারি ছিল মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ৮৫তম তারিখ। কিন্তু এই তারিখেও অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেননি কর্মকর্তা। তাই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরবর্তী সময় ধার্য করেছেন ২৩ ফেব্রুয়ারি।
আরও জানা যায়, মামলাটির অভিযোগপত্র জমা না দেওয়ায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো পিপি নিয়োগ দেওয়া যায়নি। আদালতে মামলাটি এখন দেখছেন জেনারেল রেকর্ড অফিসার (জিআরও)।
মামলাটির জিআরও পরিদর্শক জালাল উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, আদালত থেকে ৮৫ বার সময় নিয়েও তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেননি। মামলাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় হয়তো সময় বেশি লাগছে।
মামলা তদন্তের সর্বশেষ পরিস্থিতি
গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চান। এরপর ৫ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম আদালতে অগ্রগতি বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মামলাটি ২০১৯ সালের ৭ জুলাই থেকে আমি তদন্ত করে আসছি। তদন্তকালে পূর্ববর্তী তদন্ত অফিসার তদন্তের আনুষঙ্গিক কাজ করাসহ মোট আট জন আসামি গ্রেপ্তার করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে ছয় জন বর্তমানে জেল-হাজতে আছেন। দুজন জামিনে মুক্ত আছেন। মামলাটি যথাযথভাবে তদন্তের লক্ষ্যে জব্দকৃত আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতিক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আইএফএস (ইন্ডিপেনডেন্ট ফরেননিক সার্ভিস) বরাবর পাঠানো হয়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, পূর্বে পাঠানো আলামতগুলো এবং গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বুকাল সোয়াব পর্যালোচনায় অজ্ঞাতনামা দুই পুরুষ ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। তদন্তকালে ওই অজ্ঞাতনামা দুই ব্যক্তিকে (পুরুষ) চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে প্যারাবন স্ন্যাপশট নামে মার্কিন অপর একটি ডিএনএ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ডিএনএ থেকে অপরাধী/জড়িত ব্যক্তির ছবি প্রস্তুত করার সক্ষমতা রয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানটির।’
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে পূর্বের প্রতিষ্ঠান আইএফএস-এ’র সমন্বয়পূর্বক ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ছবি প্রস্তুতের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আইএফএসসে সংরক্ষিত ও বর্ণিত ডিএনএ প্যারাবন স্ন্যাপশট নামের প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহের সার্ভিস চার্জ হিসেবে ১২০০ মার্কিন ডলার ফি নির্ধারণ করায়, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আইএফএসস-কে র্যাব কর্তৃপক্ষ থেকে উল্লিখিত পরীক্ষার অগ্রগতির বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য ই-মেইল পাঠানো হয়। আইএফএস ল্যাব কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনও কোনও মতামত প্রদান করেনি। ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টাসহ মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’
‘তদন্ত সংস্থার সদিচ্ছা নেই, বিচার চেয়ে চেয়ে আমরাই এখন লজ্জিত। তাই আর বিচার চাই না।’
এ চাঞ্চল্যকর মামলাটির প্রথমে তদন্তভার গ্রহণ করেন শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক মো. জহুরুল ইসলাম। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম নতুন করে তদন্তভার নেন। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই বছরের ১৮ এপ্রিল তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন র্যাব ফোর্সেস সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম।
সর্বশেষ গত ২৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন আদালত।
এ মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন— মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মামুন, মো. কামরুল হাসান অরুণ, বকুল মিয়া, রফিকুল ইসলাম, আবু সাঈদ, এনাম আহাম্মদ ওরফে হুমায়ুন কবির, পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান। পরে পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান জামিনে ছাড়া পান। বাকিরা কারাগারে আছেন।
১৫ মাস আগে আদালতে মামলার তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে র্যাব। ওই প্রতিবেদনে র্যাব জানায়, ঘটনাস্থল থেকে জব্দ আলামত যুক্তরাষ্ট্রে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষায় দুজন অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। সেই ডিএনএ থেকে খুনে জড়িত ব্যক্তির ছবি প্রস্তুতের চেষ্টা চলছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, সব তদন্ত দ্রুত শেষ হয় না। অনেক জটিল ঘটনা থাকে যেগুলো তদন্ত সময়সাপেক্ষ। অনেক ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে তদন্তাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, র্যাব সাংবাদিক দম্পতির খুনের মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে।
১০ বছরেও শেষ হচ্ছে না ‘৪৮ ঘণ্টা’
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
ওই হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সেই সময় তিনি হত্যার রহস্য উন্মোচনের সুনির্দিষ্ট তারিখও ঘোষণা করেছিলেন। সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে এই হত্যার রহস্য উন্মোচন হবে।’
মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এই ঘোষণার পর ১০ অক্টোবর রুনির বন্ধু তানভীর রহমান ও বাসার দারোয়ান পলাশ রুদ্র পালকে গ্রেপ্তার দেখায় র্যাব। এভাবে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের নানা আশ্বাসে ১০ বছর কেটে গেছে। তারপরও এই চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮৫ বার আদালত থেকে সময় নেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিক দম্পতির নিহতের ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেন। থানা-পুলিশের বাইরে মামলাটি ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব। চার দিনের মাথায় এই হত্যা মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। এর দুই মাস পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মামলার বাদী নওশের আলম বলেন, ‘তদন্ত সংস্থার সদিচ্ছা নেই, বিচার চেয়ে চেয়ে আমরাই এখন লজ্জিত। তাই আর বিচার চাই না।’
তিনি বলেন, ‘তদন্তকাজের দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই আলোর মুখ দেখছে না এ মামলা। আমার মা কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার কষ্ট নিয়ে। সময় যতই গড়াচ্ছে ততই হতাশা বাড়ছে আমাদের। তদন্তকারী সংস্থার অদক্ষতার কারণেই বিচার হচ্ছে না।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘রাজধানীর মতো একটি জায়গায় সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্তে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে, এটা অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এখন পর্যন্ত মামলার কী অগ্রগতি এবং অপরাধী শনাক্ত হয়েছে কিনা, এসব নিয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্তকারী কর্মকর্তারা কোনও ক্লু বের করতে পারছেন না, এ দুর্বলতা মেনে নেওয়া কঠিন। আরও গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত করা জরুরি। তা না হলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ