নুর নবী দুলাল, হামবুর্গ : এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সাংবাদিকরা যাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছিল। এমনকি তার গ্রেফতারের দাবিও উঠেছিল। বিপরীতে মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। এমনকি তার প্রতিষ্ঠান এটিএন বাংলার কর্মীরা সাংবাদিকদের ওপর হামলাও চালিয়েছিল।
সাংবাদিক নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘মাহফুজুর রহমান গণমাধ্যমের শত্রু’। আট বছর আগে ২০১২ সালে এসব কিছু ঘটে। এমনকি এর বছর দুয়েক পরে, ২২ জুন, ২০১৪ তারিখেও মাহফুজুর রহমানকে প্যারিসের একটি মঞ্চে উঠতে দেননি সংক্ষুব্ধরা। এ সময় মাহফুজুর রহমানকে জুতা নিক্ষেপ করা হয়। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তায় মাহফুজুর রহমান ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
‘অবাঞ্ছিত’ সেই মাহফুজুর রহমান এখনো সাংবাদিকদের অভিভাবক। মাঝে কিছুদিন চাপে থাকলেও ২০১৬ সালে স্যাটেলাইট চ্যানলে বিদেশি টিভি সিরিজ সম্প্রচার বিতর্ককে কেন্দ্র করে তার প্রত্যাবর্তন ঘটে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেকে তখন আবার সামনে টেনে আনতে সক্ষম হন। নিজেকে এখন তিনি প্রতিষ্ঠা করছেন সাংবাদিক দরদী হিসেবে। যদিও সাগর-রুনি হত্যাকে ঘিরে সংঘটিত সেসব ঘটনার স্মৃতি এখনও সাংবাদিকদের মন থেকে মুছে যায়নি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে মাহফুজুর রহমানের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে সাগর-রুনি হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার মধ্য দিয়ে। নিহত মেহেরুন রুনী এটিএন বাংলায় কাজ করতেন। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ নিয়ে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে ১১ এপ্রিল, ২০১৫ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়, ‘মাকসুদুর রহমান রঞ্জু। এটিএন বাংলার একজন পরিচালক। তিনি এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই। পেশায় একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী যেদিন খুন হন সেদিনই তিনি দেশ ত্যাগ করেন।… র্যাবের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাই তাকে তারা গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়।… তদন্ত তদারকির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পুলিশের অন্য এক পদস্থ কর্মকর্তাও বলেন, ‘শুরু থেকে রঞ্জু তাদের সন্দেহের তালিকায় ছিলেন।’
১১ এপ্রিল, ২০১৫ তে প্রকাশিত যুগান্তরের ওই প্রতিবেদনে সংযোজিত শীর্ষ র্যাব কর্মকর্তার মন্তব্য
‘এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজের ভাই রঞ্জুর সঙ্গে তার (রুনীর) ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। যেদিন সাগর-রুনী খুন হয় সেদিনই তিনি বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আজও তিনি দেশে ফিরে আসেনি। ওর নাম মাকসুদুর রহমান রঞ্জু। ও সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে অন্যতম।’
‘হয় তো কেউ শেল্টার দিচ্ছে। রঞ্জু দেশে আসছে-গেছে তা আমার কাছে হাইড (গোপন) করে রেখেছিল। রঞ্জুর বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার তথ্য যদি আগে পেতাম তাহলে আমি দেখতাম। তবে হ্যাঁ, এখনও তাকে অ্যারেস্ট করা যেতে পারে। কারণ মামলা তো তদন্তাধীন। এখন তাকে পাওয়া গেলে সন্দেহভাজন হিসেবেই অ্যারেস্ট করা উচিত।’
‘আমি অফিসে থাকাকালীন (দায়িত্বে থাকাকালীন সময়) পেলে অবশ্যই তাকে ধরতাম। আমি মনে করি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।’
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই যখন মাহফুজুর রহমানের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে, তখন তিনি ৩০ মে, ২০১২ লন্ডনে সাগর-রুনি হত্যার ব্যাপারে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। তার ওই বক্তব্য দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ভিডিও ফুটেজ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, সেদিন প্রথমে স্বপ্রণোদিত হয়ে এ নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন এবং দ্বিতীয় অংশে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও কিছু কথা যোগ করেন। পরবর্তীতে স্যাটেলাইট চ্যানেল একুশে টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘একুশের চোখ’-এ তার ওই বক্তব্যের সম্পূর্ণ ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়।
মাহফুজুর রহমানের সেদিনের বক্তব্যের চুম্বক অংশ
‘সন্ধ্যা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল। এমন কী ঘটনা হলো, সবকিছু ফালাইয়া দিয়া, কাজ ফালাইয়া দিয়া সে রাত দুইটার সময় ফট করে বাড়িতে আসল। এটা কিন্তু সবারই প্রশ্ন যে এমন কী ঘটনার সে আলামত পাইছিল যে তার অফিসে কাউরে না জানাইয়া ফট করে রাত দুইটার সময় বাসায় গেছে। হয়তো বাসায় যাওয়ার পরে এমন কিছু দেখছে, দেখার পরে সে সহ্য করতে পারে নাই। তার ওই বাচ্চার কথায় আমার আসতে হয় যে, আমার আম্মুকে আমার আব্বু প্রথমে খুন করছে। তারপরে দুইটা গুন্ডা আমার আব্বুর হাত পা বেঁধে আমার আব্বুকে খুন করছে।’
‘যে অস্ত্র দিয়ে মারা হইছে, বটির মধ্যে ওদের (সাগর-রুনির) হাতের ছাপ ছিল। পুলিশ যে ফিঙ্গার প্রিন্ট যেটা পাইছে, সেটা ওদের হাত ছিল। তো যদি অন্য কেউ, থার্ড পার্টি যদি মারে, তাইলে বটির মধ্যে ওদের হাতের ছাপ থাকবে কেন?’
‘রুনির যে লাশটার যদি আপনারা ছবি দেখছেন কিনা জানি না, প্রথমদিন ছবিটা যেটা আমরা আবছাভাবে দেখাইছিলাম, ওর ভুড়িটা তেছরা করে কেটে ফেলা হইছে। ভুড়ির নাড়িভুড়ি সব বাইর হইয়া গেছিল। চাক্কুর মাইর কিন্তু, চাক্কু দিয়া যদি খুন করা হয় চাক্কু কিন্তু এইভাবে (হাত দিয়ে সোজা ছুরি ঢুকানোর ইশারা) স্টেব করে। চাক্কু দিয়া ওই নাড়িভুড়ি বাইর হইয়া আসে না। তাতে এটা বোঝা যাচ্ছে, বটি অথবা ওই গ্রামের বাড়িতে মুরগি, তরকারি কাটার যে চাক্কু দিয়ে এরকম (হাত দিয়ে তেছরা করে কোপ দেয়ার ইশারা) কোপ মেরে কাটা।’
বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহফুজুর রহমান আরও বলেন
‘ওদের বাসায়, যেটা আমি পরবর্তীতে জানতে পারলাম, অনেকেই যাতায়াত করত। অনেকেই যাতায়াত করত। কিন্তু এখন কেউই সেইটা প্রকাশ করতেছে না কে কে যেত। কারণ যদি কেউ প্রকাশ করে, কোনো সাংবাদিক যদি প্রকাশ করে আমি যেতাম, তাহলে কিন্তু কিছুটা দোষ তার ঘাড়ে এসে পড়বে। সেইজন্য অনেকেই প্রকাশ করতেছে না। কিন্তু তার বাসায় অনেক সাংবাদিকরাই যেত। রেগুলার যেত তার বাসায়। তার বাসায় এরকম নাকি শোনা গেছে, মদ খাওয়ার আড্ডাও চলত। বিভিন্ন সাংবাদিকরা তার বাসায় যাইয়া মদ টদ খেত। আমরা যেটা, আমি যেটা ধারণা করতেছি, বাচ্চা কখনও মিথ্যা কথা বলে না। একটি বাচ্চা কখনও মিথ্যা কথা বলে না। কারণ বাচ্চাটা, অতটুক একটা বাচ্চা, সে স্বচোক্ষে যেটা দেখছে, তার প্রথম কথাই ছিল, প্রথম ইন্টারভিউতে সে বলছিল, প্রথমে আমার আব্বু আমার আম্মুকে খুন করে। তারপরে দুইটা গুন্ডা তার বাবা-মাকে মারে। এটা প্রথম তার কথা ছিল। তার পরবর্তীকালেই সে আবার নেক্সট ডিবির একটা লোক যখন প্রশ্ন করছে তখন সে আবার আমতা আমতা উল্টাপুল্টা আবার বলছে।’
‘যারা প্রফেশনাল কিলার, তারা কিন্তু কেউ ওইভাবে খুন করবে না, বটি দিয়ে খুন করবে না। তারা চাক্কু মারলেও তাদের চাক্কু মারার স্টাইলটাই অন্য। আর তারা গুলি ইউজ করবে, তাদের হাতে নাকি পিস্তল ছিল। তারা পিস্তল ইউজ করল না কেন? তারা বটি বা চাক্কু দিয়ে কেন মারল?’
এর বিপরীতে সাংবাদিকরা তখন তদন্ত চালায়। মাহফুজুর রহমানের এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ তারা পাননি। সাগর সারোয়ারের কর্মস্থল মাছরাঙা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজোয়ানুল হক ওই দিনের কাজের শিডিউল দেখিয়ে জানান, সেদিন সাগর কাজ করছিলেন চতুর্থ শিফটে। ওই শিফট শুরু হয়েছিল সন্ধ্যায়, আর শেষ হয়েছিল রাত দুইটায়। ওইদিন সকাল ছয়টা পর্যন্ত তার ডিউটি ছিল না। রাত একটার খবর শেষে স্বাভাবিকভাবেই তিনি বাসায় যান। তিনি বলেন, ‘যে কথাটি বলা হয়েছে যে, তার ডিউটি ছিল সকাল পর্যন্ত এবং সে কাউকে না জানিয়ে বাসায় ফিরে গেছে, এই তথ্য একেবারেই ভুল… দিউটি শেষ করে সে যথাসময়েই বাসায় ফিরেছে।’ একই সাক্ষ্য দেন সাগরকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসা মাছরাঙা টিভির নিজস্ব গাড়িচালক সোহেল রানা।
সাগর-রুনি যে বাড়িতে থাকতেন সেখানকার অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এবং সাগর-রুনির ঘনিষ্ঠরা নিশ্চিত করেন যে, তাদের বাড়িতে মদের আড্ডা বসার মতো কোনো কথা তারা কখনও শোনেননি। এমনকি সাগর-রুনির ময়নাতদন্তকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, তাদের স্টোমাকে কেমিক্যাল বা অ্যালকোহল জাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় দফার ভিসেরা রিপোর্টও একই সাক্ষ্য দেয়।
সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, তারা সুখী দম্পতি ছিল। ‘আমি বলব ওরা খুব সুখী ছিল।’ রুনীর মা নুরুন্নাহার মির্জা বলেন, ‘মাহফুজুর রহমান যে বলল, ওর বাসায় আড্ডা ছিল, এইসব নিয়াই আমার ক্ষোভ।’
সাগর-রুনির পুত্র মেঘের যে সাক্ষাৎকারের কথা মাহফুজুর রহমান বলেন, তেমন কোনো ভিডিও ফুটেজ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থলে সবার আগে পৌঁছানো সাংবাদিকরাও সাক্ষ্য দেন এরকম কোনো কথা তারা মেঘের কাছ থেকে শোনেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য জানেন এবং কোনোভাবে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং সেটিকে আড়াল করার জন্য তিনি এই ভুল তথ্যগুলো দিচ্ছেন।’
সাংবাদিকদের প্রতিবাদ
সে সময় মাহফুজুর রহমানের এসব নোংরা, কুরুচীপূর্ণ মন্তব্যের বিপরীতে সাংবাদিক সমাজ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাংবাদিকদের সবগুলো জাতীয় সংগঠন একজোট হয়ে মাহফুজুর রহমানের গ্রেফতারের দাবি জানায়। এ সময় সাংবাদিকদের কর্মসূচীতে এটিএন বাংলার কর্মীদের দ্বারা হামলা চালানোর মতো ঘটনাও ঘটে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মাহফুজুর রহমান মামলাও দায়ের করেন।
৫ জুন, ২০১২ বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক মনজুরুল আহসান বুলবুলকে উদ্ধৃত করে দৈনিক প্রথম আলো লেখে, ‘সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যানের বক্তব্য ও সম্প্রতি রাজপথে টানানো ব্যানারের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়।’ একই প্রতিবেদনে আসে, ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘তিনি (মাহফুজুর রহমান) বিকৃত মানসিকতার মানুষ। রুনির বিরুদ্ধে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা তাকে প্রমাণ করতে হবে। তা না করতে পারলে সাংবাদিক সমাজ রাজপথে তার বিচার করবে।’
২৬ জুন, ২০১২ প্রথম আলো ‘মাহফুজুর রহমান গণমাধ্যমের শত্রু’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানকে ‘গণমাধ্যমের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছে সাংবাদিকদের চারটি ইউনিয়নসহ জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি। একই সঙ্গে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে।’ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (উভয় অংশ), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (উভয় অংশ), জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) যৌথভাবে এই ঘোষণা দেয়।
এ কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেন, ‘সাগর-রুনির রক্তের সঙ্গে তোমরা বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে এটিএন বাংলার কর্মীরা মানববন্ধনে হামলা চালিয়েছেন। সাগর-রুনি হত্যার তদন্তকে প্রভাবিত করার জন্য তদন্ত চলাকালে মানহানিকর ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন।’
৫ জুন, ২০১২ বিবিসি বাংলা জানায়, ‘ঢাকায় সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর এক যৌথ সমাবেশ থেকে মি. রহমানের গ্রেফতার দাবি করা হয়েছে।’ ২৫ জুন, ২০১২ বিবিসি বাংলার আরেক প্রতিবেদনে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা রুহুল আমিন গাজীকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়, ‘মাহফুজুর রহমানের লোকজন গিয়েই সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়, তিনি নিজেও সাগর-রুনি হত্যাকান্ড নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।’
২৪ জুন, ২০১২ বাংলানিউজ জানায়, ‘ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান মাইকে বলেন, ‘সাগর-রুনির মৃত্যুর জন্য এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান দায়ী। তিনি একজন খুনি, সেটা তার কথায় বোঝা যায়। আমি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের কাছে এটিএন বাংলা কার্যালয় ঘেরাও করার কর্মসূচি ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছি।’’
ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘মাহফুজুর রহমানের অর্থ-ক্ষমতা কতো বেশি, তা আমরা দেখতে চাই। সাংবাদিকদের ঐক্যের শক্তির কাছে তার ক্ষমতা কত বড় আমরা তা দেখতে চাই। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যারা এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের পক্ষে অবস্থান নেবেন, তাদের পরিণতি কী হবে তা আমরা জানি না। অতএব যারা তার পক্ষ নেবেন তা নিজ দায়িত্বে নিতে হবে। তবে আমরা সাংবাদিকদের ঐক্যে বিভক্তি কোনোভাবেই মানবো না।’
ডিইউজের আরেক সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, ‘সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করছে। আমরা এতোদিন কারো নাম বলিনি। মাহফুজুর রহমান নিজেই বলেছেন সাগর-রুনি পরকিয়ার বলি। তাকে তো এই কথা আমরা শিখিয়ে দেইনি। তিনিই বলেছেন তার কাছে অনেক ঘটনার ফুটেজ আছে। এখন তিনি ঘটনাকে অন্যখাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।’ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা মাহফুজুর রহমানের উদ্দেশে বলেন, ‘সাংবাদিক সমাজের আন্দোলন থামানোর জন্য যে মাসলম্যান আপনি মাঠে নামিয়েছেন, তা দিয়ে আমাদের আন্দোলন একদিনের জন্যও থামাতে পারবেন না।’
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ঘটনাক্রম
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রাজধানীর ফার্মগেটের পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ভাড়া বাসায়। ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ গভীর রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। এই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের আশ্বাস দেন।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলেও খুনিদের হদিশ মেলেনি। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার হত্যার তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’র কথা জানান।
চারদিন তদন্তের পর চাঞ্চল্যকর হিসেবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম দাবি করেন হত্যাকান্ডের মোটিফ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার দাবি করেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি যে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামী গ্রেফতার ও আপনাদের সামনে তাদের হাজির করতে পারব।’
কিন্তু দুই মাসে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হয় ডিবি। এর মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘দুই সাংবাদিককে নিজের ঘরে মারা হয়েছে। সরকারের পক্ষে কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে।’
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আসামীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। মামলার অগ্রগতি না থাকার কারণ দর্শানোর নোটিশও জারি করে আদালত। ঘটনার প্রায় দুই মাস পর ১৮ এপ্রিল, ২০১২ হাইকোর্টে উপস্থিত হয়ে পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম স্বীকার করেন যে, তারা খুনিদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার যায় র্যাবের কাছে।
২৬ এপ্রিল, ২০১২ র্যাবের আবেদনে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধিতা করে তখন বলেন, তিন মাস পরে লাশ উঠিয়ে নতুন কিছুই পাওয়া যাবে না। কেবল এর দ্বারা পরিচয়টা নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, এই লাশ কার। সেটা যেহেতু সকলেরই জানা, তাই এটা তদন্ত নয় বরং লোকদেখানো কাজ বলে অভিযোগ ওঠে।
র্যাবের ইনভেস্টিগেশন শাখা এখনও হত্যাকাণ্ডটি তদন্ত করছে। র্যাবের অধীনেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র তিন মাস বাকি। ইতোমধ্যে র্যাব ৭৬ বার আদালতের কাছ থেকে তদন্তের জন্য সময় চেয়েছে। এখন অবধি তারা মামলার অভিযোগপত্র আদালতের কাছে জমা দিতে পারেনি।
মাহফুজুররাই দাপিয়ে বেড়াবে!
অদ্যাবধি সাগর-রুনি হত্যা মামলার বিচারে কোনো অগ্রগতি নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই এক সময় যে সাংবাদিক সমাজের ওপর হামলা, মামলা দিয়ে মাহফুজুর রহমান আলোচিত হয়েছিলেন, এখন তিনিই সাংবাদিকদের অভিভাবক। এরকম একজন ঘৃণ্য লোকের অধীনে কিভাবে সাংবাদিকরা কাজ করেন তা নিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করেন অনেকেই। কিভাবে এরকম বিতর্কিত ভূমিকা সত্ত্বেও কিভাবে মাহফুজুর রহমানের মতো লোক সাংবাদিকদের অভিভাবক হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তর সাংবাদিক সমাজকেই দিতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, সাংবাদিকরা যতদিন নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারবে, ততদিন মাহফুজুরদের দাপট দেখে যেতে হবে। তবে আমরা যারা সাগর-রুনিকে এখনো ভুলে যেতে পারিনি, তারা আজো মাহফুজুর রহমানের ওইসব নোংরা বক্তব্যের কারণ জানতে চাই। কুরুচিপূর্ণ সেসব বক্তব্যের জন্য আমরা কখনো মাহফুজুর রহমানকে ক্ষমা করতে পারব না। আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চাই।
#justice for sagor-runi
আপনার মতামত জানানঃ