বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দশ বছরেও তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় হতাশ তাদের পরিবারগুলো। নৃশংস এ জোড়া খুনের প্রায় দশ বছর হলেও কেউ জানে না কারা খুন করেছে কিংবা কেন করেছে। দশ বছরে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য আদালত ৮৫ বার সময় দিয়েছেন। তবে এ দীর্ঘ সময়েও হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি র্যাব বা অতীতের কোন তদন্তকারী সংস্থা।
সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির অমীমাংসিত হত্যা মামলার বিষয়ে সর্বোচ্চ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন। সংগঠনটি বলেছে, এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়াটা সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আজ এক বিবৃতিতে এ হত্যাকাণ্ডের এক দশক উপলক্ষে এসব উদ্বেগের কথা জানায় সংগঠনটি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এই সাংবাদিক দম্পতি নিহত হন।
আর্টিকেল নাইনটিনের বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার, বিচার বিভাগ, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, সাংবাদিক সমিতিসহ সবাইকে সাগর-রুনি হত্যার বিচারসহ সাংবাদিকদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অতীব প্রয়োজন। আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ভূমিকা নিতে হবে।
আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, এই অমীমাংসিত মামলাটি দায়মুক্তির সংস্কৃতির শক্তিশালী অস্তিত্বের একটি লজ্জাজনক উদাহরণ। যেখানে হত্যাকারীরা মুক্ত থাকে, তা দেশের বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যেকোনো অপরাধের বিচার করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়।
ফারুখ ফয়সল আরও বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়া স্পষ্টভাবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। রাষ্ট্রের সুরক্ষাব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং নাগরিকদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এই হত্যা মামলাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করে বিচার সম্পন্ন করার জন্য বিবৃতিতে আহ্বান জানানো হয়। এর পাশাপাশি দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার জন্য এ বিষয়ে সরকারের জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এই অমীমাংসিত মামলাটি দায়মুক্তির সংস্কৃতির শক্তিশালী অস্তিত্বের একটি লজ্জাজনক উদাহরণ। যেখানে হত্যাকারীরা মুক্ত থাকে, তা দেশের বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যেকোনো অপরাধের বিচার করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়।
আদালত সূত্র বলছে, ১০ বছরে এখন পর্যন্ত ৮৫ বার সময় নিয়েও সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তের দায়িত্বে থাকা র্যাব। এই সময়ে পাঁচ বার বদল করা হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।
সবশেষ গত ২৪ জানুয়ারি মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা ছিল। ওই দিনও মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করেনি। পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন আরেকটি তারিখ ঠিক করে দেন।
আদালতের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এত সময় নেওয়া হয়, এমনটি তাদের অভিজ্ঞতায় আর নেই। এত আলোচিত একটি মামলাতে কেন এক দশকেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো না, সেটি নিয়ে তাদেরও প্রশ্নের শেষ নেই।
এদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও দ্রুত মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল চান। তারা বলছেন, মামলার তদন্ত শেষ না হলেও আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিচার হলে তারা অপরাধী হলে সাজা পাবেন, না হলে খালাস পাবেন। কিন্তু তাদেরও দিনের পর দিন হাজিরা দিয়েই যেতে হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত শেষে বিচার হলে অন্তত নিরপরাধ মানুষগুলো হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন বলে বলছেন আইনজীবীরা।
২০১২ সালে সাগর-রুনির মরদেহ উদ্ধারের পর রুনির ভাই মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্তের জন্য প্রথম ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমকে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের ভার পায় র্যাব। একে একে বদলে গেছেন আরও চার তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু মামলার তদন্তের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি।
আদালতের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ও ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর এবং সবশেষ ২০১৭ বছরের ২১ মার্চ এই মামলায় তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয় আদালতে। কিন্তু অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে হত্যা রহস্য বা এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই।
মামলার আট আসামির দু’জন পশ্চিম রাজাবাজারের ওই বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও সাগর-রুনির বন্ধু পরিচয় দেওয়া তানভীর রহমান জামিনে আছেন। বাকি ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিল ও আবু সাঈদ কারাগারে রয়েছেন। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার আট জনের কেউই এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি।
মামলায় সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। অন্যদিকে, ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও তানভীর রহমান মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘রাজধানীর মতো একটি জায়গায় সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্তে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে, এটা অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এখন পর্যন্ত মামলার কী অগ্রগতি এবং অপরাধী শনাক্ত হয়েছে কিনা, এসব নিয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্তকারী কর্মকর্তারা কোনও ক্লু বের করতে পারছেন না, এ দুর্বলতা মেনে নেওয়া কঠিন। আরও গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত করা জরুরি। তা না হলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।’
এদিকে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়েছে। শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় ডিআরইউ প্রাঙ্গণে এ প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়।
সমাবেশে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, সাংবাদিক পেশার দুজন মানুষকে এক দশক আগে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যাকারীদের প্রশাসন এখনও গ্রেফতার না করায় ক্ষোভ জানাচ্ছি। আদালত যদি এ বিচারের দিকে সুদৃষ্টি দেয় তবে সারা দেশের মানুষের প্রত্যাশার বিচার দ্রুত শেষ হবে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলাম খান তপু বলেন, ২০১২ সালের এ দিনে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুন হন। ওই বছর আমাদের প্রতিবাদের বছর ছিল। সারা দেশে দলমত নির্বিশেষে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল সেটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এ ডিআরইউ। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা সেই বিচার পাইনি। দফায় দফায় তদন্ত প্রতিবেদনের সময় বাড়ানো হয়েছে ৮৫ বার। হয়ত কয়েক দিন পরে সেটি ১০০ পার হয়ে যাবে। সেটি না করে দ্রুত আমরা বিচার চাই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০১
আপনার মতামত জানানঃ