আকৃতি ইঁদুরের আর শরীর আঁশযুক্ত হলেও এটি মাছ বা ইঁদুর কোনোটিই নয়। এদের দাঁত না থাকায় আগে দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণী বলা হলেও আসলে প্যাংগোলিন বা বনরুই স্বতন্ত্র শ্রেণির। ফোলিডোটা শ্রেণির এই প্রাণীকে এশিয়া ও আফ্রিকার বন্য পরিবেশের অংশ মনে করা হয়। কিন্তু বিশ লাখ বছর আগে এরা ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও বিচরণ করত বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। প্লাইস্টোসিন যুগের বনরুইয়ের জীবাশ্ম বা ফসিল পরীক্ষায় এই তথ্য জানা গেছে। তবে সেই থেকে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এর উল্লেখযোগ্য বিবর্তন ঘটেনি। রোমানিয়ার গ্রাউনসিয়ান এলাকায় পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক এই ফসিল। সূত্র :সায়েন্স নিউজ
বর্তমানে প্যাংগোলিনের তিনটি শ্রেণি দেখা যায়। এগুলোর একটি স্মুসিয়া, যা এখন শুধু আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বনরুইয়ের এই প্রজাতিই প্রাচীন যুগে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিচরণ করত। যার প্রমাণ সম্প্র্রতি আবিস্কার হওয়া ফসিল।
স্মুসিয়া আফ্রিকান প্যাংগোলিনের সবচেয়ে প্রাচীন প্রজাতি, যা ৫০ লাখ বছর আগেও এই এলাকায় বিচরণ করত বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাসের গবেষক ড. ক্লেইরি টারহান। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অন্তত আট ধরনের বনরুই আছে। শিকারের কারণে যার সবগুলোই বিপন্ন হওয়ার পথে।
বনরুইকে বলা হয় আঁশযুক্ত পিঁপড়াভোজী প্রাণী। ফোলিডোটা বর্গের যে আট প্রজাতির বর্ম-ঢাকা, দন্তহীন স্তন্যপায়ীর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে রয়েছে বনরুই তার একটি। বনরুইয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ প্যাংগোলিন। মালয় ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় ঘূর্ণায়মান বস্তু যা আত্মরক্ষার সময় প্রাণীটি নিজেকে বলের মতো কুঁকড়ে ফেলার অভ্যাসকে ইঙ্গিত করে।
একটি পূর্ণবয়স্ক বনরুই লম্বায় সাধারণত ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার (১-৩ ফুট) এবং ৫ থেকে ২৭ কেজি (১০-৬০ পাউন্ড) ওজনের হয়। আর এদের লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১০-২৮ ইঞ্চি) অবধি হয়ে থাকে। মুখের দিক এবং শরীরের নীচের অংশ বাদে এদের সমস্ত শরীর সিমেন্টযুক্ত এক ধরনের চুলের সমন্বয়ে বাদামী আঁশ দিয়ে আচ্ছাদিত। নাক সরু ও চোখা। জিভ লম্বা ও আঠালো যা ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। নাকের মতো এদের চোখ ও কানও সরু। আশ্চর্যজনকভাবে বনরুইয়ের সামনের নখর পেছনের নখরের তুলনায় দ্বিগুণ লম্বা।
কিছু বনরুই যেমন আফ্রিকান কালো-পেটযুক্ত ম্যানিস লংগাইডাটা ও চীনা এম. পেন্টাড্যাকটায়লা বৃক্ষবাসী এবং আফ্রিকার বৃহদাকার স্থলচর বনরুই এম. জিগান্তেয়াকে স্থলচর হিসেবে দেখা যায়। বাকি বনরুইদের সকলেই নিশাচর। দিনের বেলায় যেমন গর্তে বাস করে। একইভাবে এরা কিছুটা সাঁতার কাটতে সক্ষম। উইপোকা বনরুইয়ের প্রিয় খাবার হলেও পিঁপড়া এবং অন্যান্য পোকামাকড়ও এরা ভক্ষণ করে। গন্ধ শুকে শিকার সনাক্ত করা এই প্রাণীটির সহজাত স্বভাব।
বিশ লাখ বছর আগে এরা ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও বিচরণ করত বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। প্লাইস্টোসিন যুগের বনরুইয়ের জীবাশ্ম বা ফসিল পরীক্ষায় এই তথ্য জানা গেছে।
আপৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষার মাধ্যম হিসেবে মলদ্বার গ্রন্থি থেকে এক ধরনের তরল দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ নিঃসরণ করার পাশাপাশি শরীরকে কুঁকড়ে গোলাকার বলের মতো আকৃতি করে গড়িয়ে চলার প্রবণতা এদের মধ্যে লক্ষ্যণীয়, যা শিকারীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সাধারণত প্রাণী হিসেবে বনরুই খুবই ভীতু স্বভাবের। এরা একা বা জোড়ায় বাস করে। বেশিরভাগ প্রজাতিতে প্রতি প্রসবে কেবলমাত্র একটি যুবক জন্মগ্রহণ করে, তবে কিছু এশিয়ান প্রজাতিতে দুটি বা তিনটি পুরুষ সন্তান জন্ম নেওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। জন্মের সময় অল্প বয়স্ক বনরুইয়ের দেহাবরণ অত্যন্ত নরম থাকে এবং কিছু সময়ের জন্য মা বনরুইয়ের পিঠে চালিত হয়। যদিও এদের গড় আয়ু নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। তবে বন্দী অবস্থায় পর্যবেক্ষণকালে ২০ বছর পর্যন্ত এদের বাঁচতে দেখা গেছে।
বনরুইয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ত্বক ও আঁশ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ওষুধ তৈরির অন্যতম কাঁচামাল এবং অত্যধিক মূল্যবান হওয়ায় এদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ফলস্বরূপ, এদের সংখ্যা এত নিচে নেমে গেছে যে, একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই এরা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পরিণত হয়।
২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) চারটি প্রজাতিকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ভারতীয় এম. র্ক্যাসিকাডাটা ও ফিলিপাইনের এম. কুলিয়েনসিস্তকে বিপন্ন এবং সুন্দার এম.জাভানিকা ও চীনা একটি প্রজাতিকে অতি বিপন্ন হিসাবে দেখানো হয়েছে।
মাংসের জন্য শিকারের কারণে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বনরুই বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ভণ্ড কবিরাজরা এদের আঁশ থেকে তথাকথিত ওষুধ তৈরির কারণে প্রাণীটি মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আইএফএডব্লিউ (International Fund for Animal Welfare)- আইএফএডব্লিউ জানিয়েছে, নিরীহ বনরুই মেরে তা থেকে হাতুড়ে চিকিৎসকরা ওষুধ তৈরি করে। সেই কারণে এফ চাহিদা বেশি। ফলে বনরুই ক্রমশ অবলুপ্তির দিকে। এতে চিন্তিত ঘানা সরকার।
বনরুই মারা ও পাচার রুখতে ঘানায় সরকারি আইন আছে। তবে সেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখায় চোরাশিকারীরা। ১৯৬০ সালে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের বলেই বনরুইকে সুরক্ষা দেয় ঘানা সরকার।
দেশটির বন্যপ্রাণ বিভাগের দাবি, এই আইন দ্রুত সংশোধন করা হোক। তবে কিছুটা হলেও রুখতে পারা যাবে চোরাশিকারীদের। না হলে অদূর ভবিষ্যতে অতি সুন্দর নিরীহ প্রাণী বনরুই লুপ্ত হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ