প্রাণীরা স্রেফ জৈবিক যন্ত্র এবং তাদের আচরণ কেবল তাদের জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, কেবল সম্পর্কিত প্রাণীগোষ্ঠীর মধ্যেই একে অপরের সঙ্গে সহায়তাপূর্ণ সম্পর্ক দেখা যায়। যদি কোনো প্রাণী অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে একটি দলের অন্য প্রাণীরা সেটিকে পরিত্যাগ করে —কারণ এভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে।
অন্যদিকে এর বিপরীতক্রমে বিশ্বাস করা হয়, মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী—মানুষ তার নিজের কাজকর্ম নিয়ে সচেতন। আমাদের মধ্যে এমন মূল্যবোধ আছে, যার কারণে আমরা সম্পর্ক না থাকা অন্য মানুষের বিপদের সময়েও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই।
পৃথিবীতে প্রাণীর প্রায় দশ লাখের বেশি প্রজাতি আছে। সি স্পঞ্জ বা ঝিনুকের মতো অনেক প্রাণী যে স্রেফ জৈবিক যন্ত্র, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। আবার বেশিরভাগ প্রজাতিরই জটিল অবধারণগত সক্ষমতা বা সমানুভূতি নেই।
কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, কেবল মানুষ নয়, বিপদে অন্য গোত্রের প্রাণকে সহায়তা করার মানসিকতা আরও কিছু প্রজাতির প্রাণীরও রয়েছে। শিম্পাঞ্জি, হাতি, ও সিটাশিয়ান এ ধরনের আচরণের দিক থেকে নিজেদের আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে।
মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে শিম্পাঞ্জি অন্য দলের শিম্পাঞ্জির গায়ের ক্ষতের চিকিৎসা করতে পোকা ব্যবহার করে। নাইজেরিয়ার গম্বে স্টেটে শিম্পাঞ্জিকে দেখা গেছে গাছের পাতা ব্যবহার করে ক্ষত পরিষ্কার করতে।
পশ্চিম আফ্রিকার তাই জাতীয় উদ্যানে বাস করা শিম্পাঞ্জিরা অসুস্থ শিম্পাঞ্জির দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখে। যেমন দেখা যায়, শিম্পাঞ্জি পালের গোদা অন্য কোনো শিম্পাঞ্জিকে অসুস্থ শিম্পাঞ্জিকে বিরক্ত করতে দেয় না। আহত প্রাণীটি হাঁটতে শুরু করার আগ পর্যন্ত পুরো দল তার জন্য অপেক্ষা করে।
২০১১ সালে শিম্পাঞ্জির সহায়তামূলক আচরণ নিয়ে একটি বিস্তৃত গবেষণা করা হয়। সেখানে দেখা যায়, একটি তরুণ শিম্পাঞ্জি দুই দিন ধরে অন্য দলের একটি আহত মা শিম্পাঞ্জিকে তার বাচ্চা বইতে সহায়তা করছে। দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল না মা-টি, তখন তরুণ শিম্পাঞ্জিটি বাচ্চাকে বেশিরভাগ সময় বহন করে।
শিম্পাঞ্জির বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে পুরুষ শিম্পাঞ্জিরও এভাবে অন্যের বাচ্চা বহন করার নজির রয়েছে।
শিম্পাঞ্জির এতিম বাচ্চাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করার অনেক ঘটনার কথাও জানা গেছে। এভাবে দত্তক নেওয়া সন্তানকে শিম্পাঞ্জি নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে, খাওয়ায়, শত্রুর কাছ থেকে রক্ষা করে। এমনকি ভিন্ন দলের শিম্পাঞ্জির বাচ্চা দত্তক নেওয়ার নজিরও রয়েছে।
বিপদে এক হাতি অন্য হাতিকে সাহায্য করার অনেক ঘটনার কথা জানা যায়। মা ও বোন হাতির অসুস্থ বাচ্চাকে তুলে নেওয়া, কাদা থেকে উদ্ধার করা, বা নদী পার হতে সাহায্য করা বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। তবে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন দলের অপরিচিত হাতিকে সাহায্য করতেও দেখা গেছে।
২০০৬ সালে হাতির সহায়তামূলক আচরণ নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। একটি দলের প্রধান মা হাতি সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এর মিনিট দুয়েক পরে অন্য পরিবারের আরেকটি মা হাতি ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে আসে।
নতুন মা হাতিটি এলেনর নামক অজ্ঞান হাতিটির গায়ের গন্ধ নেয়, এরপর শুঁড় ও পা দিয়ে দেহটি নাড়াচাড়া করে। তারপর এটি শুঁড় ব্যবহার করে এলেনরকে পুনরায় দাঁড়াতে সহায়তা করে। এ ঘটনার পরের দিন এলেনর মারা যায়। তখন বিভিন্ন আলাদা আলাদা হাতির দল তার মৃতদেহটি দেখতে আসে।
সিটাশিয়ান হচ্ছে তিমি, ডলফিন, শুশুক ইত্যাদির মতো স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক প্রাণী। এ প্রাণীগুলোর উচ্চ অবধারণগত ক্ষমতা ও যোগাযোগ দক্ষতা রয়েছে। ফলে এগুলো নিবিড় সামাজিক সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখতে সক্ষম।
বিভিন্নভাবে অন্যদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে ডলফিনের বেশ সুনাম রয়েছে। মাছ ধরার জালে আটকা পড়া মানুষকে মুক্ত করা, উপকূলের কাছে অসুস্থ মানুষকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করা, বাচ্চা প্রসব করা মা ডলফিনের আশপাশে থাকা, আহত ডলফিন ও নৌকা যেন সংঘর্ষের মুখে না পড়ে তাই দুয়ের মাঝখানে অবস্থান নেওয়া—ডলফিনের সাহায্য করার এ ধরনের অনেক ঘটনা মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।
সিটাশিয়ানদের এক প্রজাতির অন্য প্রজাতিকে সহায়তার ঘটনাও রয়েছে। একটি ঘটনায় দুটি ডলফিনকে পালা করে নবজাত একটি শুশুকের বাচ্চাকে পানির ওপর ভাসিয়ে রাখতে দেখা গেছে। অর্কা যখন অন্য প্রজাতিকে শিকার করে, তখন হাম্পব্যাক তিমি নিজের জীবন বিপন্ন করে এগুলোকে বিরক্ত করার চেষ্টা করে। সূত্র: টিবিসি।
এসডব্লিউএসএস/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ