চলতি বছরের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ (ইউএনএইচআরসি)। এ পরিষদের গুমসংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ডব্লিউজিইআইডি (ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস) এ প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বাংলাদেশ পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয়েছে।
ইউএনএইচআরসির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ বছর ওয়ার্কিং গ্রুপ তিন সেশনে অনুষ্ঠিত ঘরোয়া বৈঠকে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত নতুন পুরনো গুমের ঘটনা এবং এ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করেছে। এর বাইরে অন্যান্য সাধারণ অভিযোগও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে গুমকে অব্যাহতভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। গুমের এসব অভিযোগের বিষয়ে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।
ওয়ার্কিং গ্রুপের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকার বা রাজনৈতিক বিরোধিতার বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা প্রতিরোধে গুমকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গুমসহ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়।
গত ২০ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়ার্কিং গ্রুপের ওই বৈঠক হয়। ৬ ডিসেম্বর এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন হালনাগাদ করেছে ওয়ার্কিং গ্রুপ। এখন পর্যন্ত গুমের ঘটনা ঘটেছে এমন দেশগুলোকে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। গুমের অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং এ নিয়ে পরামর্শসহ ওয়ার্কিং গ্রুপের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রসঙ্গও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং তাদের ও সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে।
গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতে ওয়ার্কিং গ্রুপ তাদের এবং সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিনিধিদের গুম বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ও সংগৃহীত তথ্য সংগ্রহ করেছে। পরে লিখিতভাবে বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায় গ্রুপটি।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে অভিযোগ জানিয়েছে এবং ওয়ার্কিং গ্রুপ এ বিষয়ে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল। এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ১২ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো জবাব দেওয়া হয়নি, যা আরও বেশি অস্বস্তির। ওয়ার্কিং গ্রুপ বলেছে, মনে রাখা দরকার, যত অভিযোগ পাওয়া গেছে, এর সবই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব সংস্থা ও বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা অন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করার জন্য বারবার ও অব্যাহতভাবে গুমকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুম করেছে। তাদের বেশির ভাগকে হয় মুক্তি দেওয়া হয়েছে কিংবা শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ব্যক্তি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে বেশ কয়েকজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সূত্রগুলো ৮৬টি নথিভুক্ত ঘটনার কথা জানিয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ভাগ্য ও অবস্থান সম্পর্কে অজানা রয়ে গেছে। সূত্রগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে বাংলাদেশ পুলিশের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ সক্রিয়ভাবে জড়িত; যা ২০১৮ সালের মে মাসে শুরু হয়। নিয়মিতভাবে লোকজনকে তুলে নেওয়া, বিচারবহির্ভূতভাবে তাদের হত্যা করা ও লাশ গুম করার বেশির ভাগ ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি সবার জানা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরোধীদের ওপর উল্লিখিত দমনমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গুম করার জন্য কীভাবে নজরদারি (শারীরিক নজরদারি; সেই সঙ্গে টেলিফোনে আড়ি পাতা; আন্তর্জাতিক মোবাইল গ্রাহক পরিচয়-শনাক্তকরণ, অবস্থানভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক মনিটরিং সিস্টেম সফটওয়্যার ও ওয়াইফাই ইন্টারসেপ্টরের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম ট্র্যাকিং) চালানো হয় তা জানিয়েছে সূত্রগুলো। নজরদারির কৌশলগুলো মহামারির প্রেক্ষাপটে বেড়েছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের নিশানা করা হচ্ছে, যারা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের সাড়ার বিষয়ে সমালোচনামুখর বলে মনে হয়।
এতে আরও বলা হয়েছে, সূত্রগুলো ওয়ার্কিং গ্রুপকে জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত যাতে না হয়, সে জন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। গুম হওয়া প্রিয়জনকে মুক্তি বা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। সূত্রগুলো ওয়ার্কিং গ্রুপকে আরও জানায়, এমন অভিযোগ আছে, পুলিশ কর্মকর্তারা গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে অস্বীকার করেন বা শুধু তখনই গ্রহণ করেন, যখন সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার যেকোনো ধরনের অভিযোগ বাদ দেওয়া হয়। যখন অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়, তখন দৃশ্যত কোনো তদন্ত হয় না ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যেসব ক্ষেত্রে আদালতের তদন্তের নির্দেশ রয়েছে, সেখানেও এমনটা হয়।
সরকার বা রাজনৈতিক বিরোধিতার বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা প্রতিরোধে গুমকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গুমসহ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ার্কিং গ্রুপ কথিত আইনি ব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কেও অবগত হয়েছে; যা অপরাধীদের দায়মুক্তি সহজতর করে। কথিত এ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা বা তা পুনরুদ্ধারে যেকোনো কাজের জন্য একজন সরকারি কর্মকর্তাকে আইনি পন্থায় নিরাপত্তা দিতে জাতীয় সংসদের সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর আরোপিত কোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার নিশ্চয়তা। এ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আরও আছে দায়িত্ব পালনকালে সংঘটিত অপরাধের জন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনার আগে সরকারি অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। উপরন্তু সূত্রগুলো জানিয়েছে, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিন্যান্সের ১৩ ধারা র্যাবের যেকোনো সদস্যের বিচার কার্যত অসম্ভব করে তোলে।
প্রসঙ্গত, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদের আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে ঘনঘন গুমের ঘটনার বিষয়টির সাথে আমরা একমত নই। নিখোঁজ ব্যক্তিদের গুম হিসেবে চালিয়ে দেয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের অভিযোগ সরকারের অর্জন ও ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করার হীনউদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।
অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতা ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না, বরং পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য গুমকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ আগে যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্টে, বাসে, ট্রেনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো, তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কোনো আলোচনা হতে দেখি না। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে গুমের মত ঘটনা এমন একটা অবস্থায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মানুষ আর এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবছে না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ‘নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নিখোঁজের কোনো অভিযোগ আসামাত্র তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। নিরপেক্ষভাবে তার তদন্ত করতে হবে। ভিকটিম পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানাতে হবে।’
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ