বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছেই দুবাই এক স্বপ্নের শহর। না, নিছকই কোনো কথার কথা নয় এটি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যাতায়াত ব্যবস্থা, আকাশচুম্বী ভবন ও মল দিয়ে সমৃদ্ধ মধ্য প্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই শহরটি বাস্তবিকই পর্যটকদের কাছে অতি জনপ্রিয় এক গন্তব্য। দুবাই যেন এবার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। বিশ্বের কোনো দেশ এখনো শতভাগ ডিজিটালাইজড হতে না পারলেও প্রথম হিসাবে দুবাই সেদিকেই এগিয়ে গেল।
বিশ্বে প্রথমবারের মতো শতভাগ কাগজহীন সরকার ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দিয়েছে দুবাই। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন শেখ হামদান বিন মোহাম্মদ বিন রশীদ আল মাকতুম গত শনিবার এ ঘোষণা দেন। নথিপত্র ছাড়া সবকিছু ডিজিটাল করার ফলে বিলাসবহুল শহর দুবাইয়ের এক দশমিক ৩ বিলিয়ন দিরহাম ও এক কোটি ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা বেঁচে যাবে।
দুবাই সরকারের সব ধরনের অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক লেনদেন এবং পদ্ধতি এখন শতভাগ ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে। ডিজিটাল এই ব্যবস্থা সমন্বিত ডিজিটাল সরকারি পরিষেবা প্ল্যাটফর্ম থেকে পরিচালিত হবে।
এক বিবৃতিতে শেখ হামদান বলেছেন, এই লক্ষ্য অর্জন দুবাইয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব দিককে ডিজিটালাইজ করার যাত্রায় নতুন ধাপের সূচনা করেছে। উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা এবং ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ করেই এই যাত্রা শুরু হয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ডিজিটাল রাজধানী হিসেবে দুবাইয়ের মর্যাদাকে আরও শক্তিশালী করবে। গ্রাহকদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে এমন সরকারি কর্মকাণ্ড এবং পরিষেবার পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে দুবাইকে রোল মডেল হিসেবে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরবে বলে মন্তব্য করেছেন দুবাইয়ের এই প্রিন্স।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এবং কানাডা ব্যাপক পরিসরে সরকারি সব কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। সরকারি বিভিন্ন সেবা এবং নাগরিক সনাক্তকরণ কার্যক্রম এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করার কথা রয়েছে। তবে সংশয়বাদীরা শতভাগ ডিজিটাল কার্যক্রম ব্যবস্থায় সাইবার হামলার ঝুঁকির ব্যাপারে যুক্তি দিয়েছেন।
দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স বলেছেন, ‘সরকার আগামী পাঁচ দশকে দুবাইয়ে ডিজিটাল জীবন ব্যবস্থা তৈরি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উন্নত কৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।’
তিনি বলেছেন, দুবাইয়ের ডিজিটাল যাত্রার নতুন ধাপ বাসিন্দাদের সমৃদ্ধ স্মার্ট শহরের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ভবিষ্যৎ সরকারকে সক্ষম করে তুলবে। একই সঙ্গে তাদের জন্য সমৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন এবং সুখের নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করবে।
দুবাইয়ের কাগজহীন সরকারের কৌশল ২০১৮ সালে গ্রহণের পর ক্রমান্বয়ে পাঁচ ধাপে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যার প্রত্যেকটিতে দুবাইয়ের সরকারের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে আনা হয়েছে।
একেবারে শেষ ধাপে এই কৌশল পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে সরকারের ৪৫টি প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক হাজার ৮০০টিরও বেশি ডিজিটাল পরিষেবা এবং সাড়ে ১০ হাজারের বেশি বড় ধরনের লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ, যা গড়ে উঠেছে সাতটি আমিরাতের সমন্বয়ে। এই আমিরাতগুলো ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত ‘ট্রুসিয়াল স্টেটস’ নামে। সমগ্র দেশটির রাজধানী হলো আবুধাবি। তবে বাকি আমিরাতগুলো, অর্থাৎ আজমান, ফুজাইরাহ, শারজাহ, দুবাই, উম্মুল কুয়াইন এবং রাআস আল খাইমাহের রয়েছে আলাদা আলাদা রাজধানী। তেমনই দুবাই আমিরাতের রাজধানী হলো দুবাই।
দুবাইয়ের অবস্থান আরব মরুভূমির মাঝে। আর এর উত্তর সীমান্তে রয়েছে আবুধাবি, দক্ষিণ-পশ্চিমে শারজাহ, পূর্বে আজমান, দক্ষিণে রাআস আল খাইমাহ এবং উত্তর-পশ্চিমে ওমান।
দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ের বিশেষ খ্যাতি ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ার এবং সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন পুলিশ কারের মালিক হিসেবে। তবে এখন আর এটুকুতেই সন্তুষ্ট নয় তারা। নিজেদের জন্য আরো বড় একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তারা। আর সেটি হলো ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে স্মার্ট ও সুখী শহরে পরিণত হওয়া।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনপ্রিয় ও প্রধান আকর্ষণীয় রাজ্যের নাম দুবাই। বিলাসবহুল জীবনযাপন, চোখ ধাঁধানো রঙিন আলোকরশ্মি, আকাশচুম্বি অট্রালিকা, হোটেল, কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জসহ নানা কারণে দুবাই ভ্রমণ-প্রিয়দের পছন্দের শীর্ষে।
পর্যটকদের জন্য দুবাই অত্যন্ত আকর্ষণীয় শহর। মরুভূমির দেশ দুবাইয়ে রয়েছে উপভোগ করার মতো অনেক কিছু। পৃথিবীর অন্যতম অভিজাত এয়ারলাইন্স এমিরেটসের কারণে দুবাইয়ে যাওয়া হয় প্রতিদিন লাখো বিমানযাত্রীর।
বুর্জ আল খলিফা, বুর্জ আল আরব, দুবাই মল, পাম আইল্যান্ড, স্কাইডাইভিং, মরুভূমিতে সাফারি, মিরাকল গার্ডেন, কোরআন পার্ক, প্রমিজ ব্রিজসহ অনেকগুলো আকর্ষণীয় জায়গা ও অ্যাডভেঞ্চারের জন্য বিখ্যাত এ শহরটি। অতীতে দুবাইয়ে ভ্রমণ ভিসার অপব্যবহারের জন্য সবধরনের ভিসা বন্ধ করে রেখেছিল আরব আমিরাত। ২০১২ সালে বন্ধ হবার পর এ বছর আবার ভিজিট ভিসা দেয়া শুরু করেছে তারা।
স্মার্ট দুবাইয়ের রয়েছে দুর্ধর্ষ ও চমকপ্রদ সব পরিকল্পনা, যেগুলোর বিবরণ এতদিন পৃথিবীবাসী কেবল কল্পবিজ্ঞানের পাতায়ই পড়ে এসেছে, কিংবা পর্দায় দেখেছে। স্মার্ট দুবাই নীলনকশা সাজিয়েছে তাদের আকাশে ফ্লাইং ট্যাক্সি উড়িয়ে বেড়ানোর, রাস্তায় রাস্তায় অন-ডিমান্ড অটোনোমাস যানবাহন ছড়িয়ে দেয়ার, এবং শহর প্রতিরক্ষায় রোবোকপ নিয়োগ দেয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে তারা প্রতি বছর ডিজিটালি সম্পন্ন করতে পারবে ১০০ মিলিয়ন কাগুজে দলিলের কাজ।
এভাবেই কাগজকে বিদায় করে দিয়ে এবং সরকার ব্যবস্থাকে ব্লকচেইনে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে স্মার্ট দুবাই স্বপ্ন দেখছে শহরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে স্মার্ট, পরিচ্ছন্ন ও সুখী দেশে পরিণত করার।
এ ধরনের প্রকল্প যে শুধু দুবাইতেই শুরু হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বিশ্বের প্রায় সকল বড় শহরই এখন নিজেদেরকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশির্বাদধন্য করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুবাইয়ের বিশেষত্ব এই যে, তাদের চেষ্টা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তারা সফলতা লাভের পথে বেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ