ভারতে প্রথমবারের মতো পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে প্রতি এক হাজার পুরুষের বিপরীতে নারী আছেন এক হাজার ২০ জন। পাশাপাশি দেশটিতে জন্মহার কমেছে। ভারত সরকার কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত হালনাগাদ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের (এনএফএইচএস)এ তথ্য আলোড়ন তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমীক্ষাটি ভারতের ৩০ কোটি পরিবারের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ ৩০ হাজার পরিবারের মধ্যে চালানো হয়েছে। ফলে এতে উঠে আসা চিত্র পূর্ণাঙ্গ নয়। বরং আদমশুমারির তথ্য পেলেই প্রকৃত চিত্রটি উঠে আসবে।
এদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে অল্পবয়সী নারী বা পুরুষের সংখ্যাও কমতির দিকে। তবে এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিষয়টিকে বরং এভাবে দেখা হচ্ছে— মজবুত উন্নয়নের দিকে দেশের গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। আবার ভারতে জনবিস্ফোরণের যে আশঙ্কা অনেকের ছিল, আপাতত তার আশঙ্কাও নেই।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জনতাত্ত্বিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে ভারতে এক হাজার জন পুরুষের বিপরীতে নারীর সংখ্যা ছিল ৯২৭। ২০০৫-০৬ সালের সমীক্ষায় পুরুষ ও নারীর সংখ্যা সমান ছিল। ২০১৫-১৬ সালে তা কিছুটা কমে যায়। তখন নারী ও পুরুষের অনুপাত ছিল ৯৯১:১০০০। এবারই প্রথম পুরুষদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে নারী।
প্রথম পর্যায়ের সমীক্ষায় ২২টি প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জরিপ করা হয়েছিল। যার ফলাফল গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৪টি প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জরিপ করা হয়েছে, যার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ভারতে এই প্রথম নারীর সংখ্যা পুরুষ জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বিকাশ শীল। তিনি বলেন, ‘আদমশুমারি থেকে আসল ছবিটা স্পষ্ট হলেও এই ফলাফলের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি যে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমাদের পদক্ষেপগুলো সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জনতাত্ত্বিক জরিপের দিকে লক্ষ্য করে আমরা বলতে পারি, উন্নত দেশ হওয়ার পথে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানে তাদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রোধসহ ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, নারী ক্ষমতায়নের জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের ফলেই জনসংখ্যার এমন অনুপাত দৃশ্যমান হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়াতেও এটিকে বিশাল অর্জন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন সাংবাদিক লিখেছেন, ভারত এখন উন্নত দেশগুলোর লীগে প্রবেশ করেছে। তবে সমালোচকরা সরকার ও সরকার সমর্থক মিডিয়ার এমন দাবিকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১৯৯০ সালে ‘নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’এ একটি নিবন্ধে ভারতকে ‘কান্ট্রি অব মিসিং উইমেন’ বলেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তিনি যখন এমন মন্তব্য করেছিলেন তখন ভারতে নারী-পুরুষ অনুপাত ছিল ৯২৭:১,০০০। সেই অনুপাত এখন ১,০২০:১,০০০। অর্থাৎ ভারতকে আর ‘কান্ট্রি অব মিসিং উইমেন’বলা যাবে না।
এদিকে ভারতের ১৪টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৩০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে পিটুনি খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মতামত দিয়েছেন। সম্প্রতি দেশটিতে চালানো ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫ শীর্ষক এক জরিপের ফলে এই তথ্য উঠে এসেছে।
স্বামীর এমন আচরণের পেছনে নারীদের একটা বড় অংশের দাবি, ঘর ও বাচ্চাদের অবহেলা করলে, শ্বশুরবাড়ির প্রতি অশ্রদ্ধা, বেশি মুখরা হওয়া, নানা কারণে স্ত্রীকে সন্দেহ, শারীরিক সম্পর্কে না জড়াতে চাওয়া, স্বামীকে না বলে বাইরে যাওয়া, ঘরের কাজকর্ম না করা, ভালো খাবার তৈরি না করার কারণে স্বামীরা স্ত্রীদের গায়ে হাত তুলতেই পারেন।
দেশজুড়ে চালানো জাতীয় সমীক্ষায় নারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার মতে স্ত্রীকে পেটানো স্বামীর পক্ষে কি যৌক্তিক? জবাবে দেশটির অন্তত ১৪টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের ৩০ শতাংশ নারী হ্যাঁ বলে জানিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর পিটুনির পক্ষে তারা যুক্তিও দিয়েছেন। বলেছেন, তারা মনে করেন বিশেষ পরিস্থিতিতে স্ত্রীর গায়ে স্বামীদের হাত তোলার মধ্যে যুক্তি আছে।
জরিপে দেশটির অন্তত তিনটি রাজ্যের ৭৫ শতাংশেরও বেশি নারী মেনে নিয়েছেন স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলায় যুক্তি রয়েছে। তেলেঙ্গানার ৮৪ শতাংশ, অন্ধ্র প্রদেশে ৮৪ শতাংশ ও কর্ণাটকে ৭৭ শতাংশ নারী বউ পেটানো স্বামীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
বিভিন্ন রাজ্যে এই সংক্রান্ত পরিসংখ্যানেও স্ত্রীকে স্বামীর পেটানোর পক্ষে মত দিয়েছেন নারীরা। যেমন দেশটির মণিপুরে ৬৬ শতাংশ, জম্মু ও কাশ্মীরে ৪৯ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ও পশ্চিমবঙ্গে ৪৪ শতাংশ নারী মনে করেন, স্ত্রীকে পেটানোর মধ্যে যুক্তি আছে।
স্বামীর এমন আচরণের পেছনে নারীদের একটা বড় অংশের দাবি, ঘর ও বাচ্চাদের অবহেলা করলে, শ্বশুরবাড়ির প্রতি অশ্রদ্ধা, বেশি মুখরা হওয়া, নানা কারণে স্ত্রীকে সন্দেহ, শারীরিক সম্পর্কে না জড়াতে চাওয়া, স্বামীকে না বলে বাইরে যাওয়া, ঘরের কাজকর্ম না করা, ভালো খাবার তৈরি না করার কারণে স্বামীরা স্ত্রীদের গায়ে হাত তুলতেই পারেন।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গসহ ১৩টি রাজ্যের নারীদের অভিমত, স্ত্রীর তরফে শ্বশুরবাড়ির লোকদের অশ্রদ্ধাই পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সংসার ও সন্তানদের অবহেলা করা। এই সম্ভাব্য কারণের তালিকায় সবার নিচে রয়েছে পরকীয়ার সন্দেহ। কিন্তু মিজোরামের নারীদের মতে আবার সেটাই প্রধান কারণ।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার আগের রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, সারা ভারতের ৫২ শতাংশ নারী এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ পারিবারিক হিংসাকে যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বিভিন্ন রাজ্যে ওই শতকরা হার আশির ঘরে পৌঁছানো নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকে। নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান সারদা এ এল বলছেন, এ হলো এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, যা নারীদের একাংশের মনের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা মনে করছেন, পরিবার ও স্বামীর সেবা করে যাওয়াটাই তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ