সংসদ নির্বাচন হোক বা উপজেলা নির্বাচন; বাংলাদেশের নির্বাচনে শক্তি প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার, কারচুপি খুব প্রকাশ্য সত্য। ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ৩৮ স্কোর করেছে৷ সে হিসেবে ১৬৬টি দেশের মধ্যে ২১টি দেশের চেয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনের মান ভালো৷
দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তানের (৩৪) চেয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনের মান ভালো৷ অন্যান্য দেশগুলোর স্কোর ভুটান (৬৬), ভারত (৫৯), নেপাল (৫৬), মালদ্বীপ (৫২), শ্রীলঙ্কা (৫২) ও পাকিস্তান (৪৭)৷
সম্প্রতি বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বর্জনের মুখে প্রায় একদলীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটে চলেছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকিও দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।
একনায়কতন্ত্র নাকি গণতান্ত্রিকভাবে একনায়কতন্ত্র— কোনটি বেশি ভয়ংকর। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতার বলেন, ‘সিভিলিয়ান অটোক্র্যাট’ বা ‘বেসামরিক স্বৈরশাসক’ বলে একটি কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু আছে। অনেক সময় গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র দেখে অনেক সামরিক শাসকও লজ্জা পেতে পারে।
এখানে বলে রাখি, প্রায় ৩ বছর আগেই বাংলাদেশ বিশ্বের নতুন একনায়কতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসমান স্টিফটুং তাদের গবেষণা থেকে এমনটি জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০টি দেশের সরকার দুই বছর ধরে আইনের শাসনকে ‘বন্দী’ করে রেখেছে। অন্যদিকে ৫০টি দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। সারা বিশ্বেই গণতন্ত্র এখন চাপের মুখে রয়েছে।
দেশে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। তবে গুরুত্ব ভেসে গেছে সহিংসতার বানে। প্রতিযোগিতার নাম-গন্ধ নেই। আছে সন্ত্রাস। আছে লাশের গন্ধ। আহতের চিৎকার। ভোটারদের নিরাপত্তাহীনতা। মানুষের অসহায়ত্ব আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অপচেষ্টা।
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি বাক বদল হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের সাধারন নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আরো দুটি সাধারন নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু সেসব নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরণের প্রশ্ন রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একটানা ১২ বছর ক্ষমতায় রয়েছে।
… সেই একই প্রশাসন আর নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজিত দেখিয়ে অন্যান্য দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষনা করাটা নিশ্চয়ই সহজ ভাবে দেখার অবকাশ নেই।
আওয়ামী লীগ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিগত এক যুগে সংগঠিত নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের অনুপস্থিতি কিংবা ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদানের সংষ্কৃতির সৃষ্টি করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। আর এভাবেই প্রার্থীদের ব্যাপক ভোটে নির্বাচিত ঘোষনা করে অন্যান্য দলীয় প্রার্থিদের জামানত বাজেয়াপ্ত করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। সেই একই প্রশাসন আর নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজিত দেখিয়ে অন্যান্য দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষনা করাটা নিশ্চয়ই সহজ ভাবে দেখার অবকাশ নেই।
এটা হতে পারে আওয়ামী লীগের সুপরিকল্পিত ফাঁদ। হতে পারে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠুভাবে হয়, এটা প্রমাণের কৌশল। যাতে মানুষ ভাবে তাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলেও শঙ্কার কোনও কারন নেই। এই যুক্তি দেখিয়ে নিজেদের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ফাঁদ হতে পারে এই ইউপি নির্বাচন। যা হবে আরেকটি নির্বাচনী প্রহসন। মনে রাখতে হবে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। সবগুলো ইউনিয়ন পরিষদে জয়লাভ করে জাতীয় নির্বাচনে হেরে গেলে কোনও লাভই হবেনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সহজ দৃষ্টিতে দেখলে এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের চিত্র শেখ হাসিনা সরকারকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে না যাওয়ার পক্ষে শক্ত অবস্থানের সৃষ্টি করবে। এই নির্বাচনের উপর দাঁড়িয়ে তারা আবারও যে কোনও উপায়ে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের প্রচেষ্টা চালাবে।
অনেক রাজনীতিবিদ মনে করছেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীদের জয়ের সংখ্যাটা বেশি দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার করতে পারে যে বাংলাদেশে আবারও ইসলামী মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামীলিগ ক্ষমতায় না আসতে পারলে এদেরকে দমানো সম্ভব হবে না।
সেক্ষত্রে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল চোখ বন্ধ করে রাখবে যেমনটা গত নির্বাচনে ঘটেছিলো। আর তাদেরকে সহযোগিতা করতে ভারত সরকার কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তা সবাই জানে। তাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জয় পরাজয়কে খুব একটা বড় অর্জন বিবেচনা না করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকা উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি পথই আছে আর সেটি হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। এছাড়া আমাদের মুক্তির ভিন্ন কোনও পথই খোলা নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ