দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুর্নীতি মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বরখাস্ত উপপরিদর্শককে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ আদেশ দেন। দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, দুদকের একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন সিআইডির বরখাস্ত কর্মকর্তা এসআই নওয়াব। কিন্তু আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন। ওই মামলায় নওয়াবের স্ত্রী গোলজার বেগম জেল খেটে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। এছাড়াও বাকি দুই আসামি কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) বাহার উদ্দিন চৌধুরী ও কর পরিদর্শক দীপঙ্কর ঘোষ পলাতক রয়েছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এসআই নওয়াব সর্বশেষ ঢাকা সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন। দুদকের তথ্য মতে বর্তমানে এই দম্পতির ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ সম্পদের মালিক স্ত্রী গোলজার। যা জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এ ঘটনায় এসআই নওয়াব আলী, তার স্ত্রী গোলজার বেগম, কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) বাহার উদ্দিন চৌধুরী ও কর পরিদর্শক দীপঙ্কর ঘোষকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করে এই চার আসামির বিরুদ্ধে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৯২ সালে কনস্টেবল পদে যোগ দেন নওয়াব আলী। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা আয় করলেও অর্জিত টাকার মালিক দেখান স্ত্রীকে। মাছ চাষ থেকে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা আয় করেছেন বলে কাগজপত্রে দেখালেও বাস্তবে মাছ চাষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবুও দুজন কর কর্মকর্তা তার মাছের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেন।
দুদকে জমা দেয়া হিসাব বিবরণীতে গোলজার দাবি করেন, তিনি মিরসরাইয়ের পশ্চিম ইছাখালীর মদ্দারহাটে হারেস আহমদ, আমিনুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, শওকত আকবরসহ সাতজনের সঙ্গে চুক্তি করে একটি জলমহাল ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেছেন।
তবে তদন্তে উঠে আসে, হারেস আহমদসহ যেসব ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি দেখানো হয়েছে, তারা ২০ বছর আগে মারা গেছেন। তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি।
এ ঘটনায় দুদক নওয়াব আলী, তার স্ত্রী গোলজার বেগম, কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রামের সাবেক অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার বাহার উদ্দিন চৌধুরী ও কর পরিদর্শক দীপংকর ঘোষকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়।
নওয়াব আলীর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের কেকানিয়া এলাকায়। সেখানে তিনি ২০১৩ সালে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ জমির ওপর একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এই বাড়িটি তার নামে আছে।
স্ত্রীর নামে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ছলিমপুরে ৩৫৪ শতক জমি, চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার এলাকায় পার্কিং এরিয়াসহ ১ হাজার ১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, একই এলাকায় ৪ শতক জমি আছে। গোলজারের নামে একটি মাইক্রোবাসও আছে।
ওই মামলায় নওয়াবের স্ত্রী গোলজার বেগম জেল খেটে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। এছাড়াও বাকি দুই আসামি কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) বাহার উদ্দিন চৌধুরী ও কর পরিদর্শক দীপঙ্কর ঘোষ পলাতক রয়েছেন।
এদিকে সম্প্রতি সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতে দুদকের মামলায় ১৬ জন পুলিশ সদ্যসের নাম এসেছে। মাগুরায় সরকারি তহবিল থেকে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মামলায় পুলিশের বর্তমান ও সাবেক ১৬ জন সদস্য, সোনালী ব্যাংকের ১ জন, হিসাবরক্ষণ অফিসের ৮ জনসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। ২০১৭–২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) ও নিরাপত্তা জামানত (ডিপোজিট অ্যাগেইনস্ট ওয়ার্কস অ্যান্ড সাপ্লাই) অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ১ হাজার ৩৪৮ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার বাদী মাহফুজ ইকবাল বলেন, ২৭ জন আসামির মধ্যে অধিকাংশ পুলিশের বর্তমান ও সাবেক সদস্য। এছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাও আসামির তালিকায় আছেন।
মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভুয়া বিল তৈরি করে বড় অঙ্কের সরকারি অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনা ঘটে।
এদিকে ব্যাপক ক্ষমতা পাওয়ার পর দিনদিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। ইয়াবাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম পুলিশের নানা অপরাধ বাড়ছে যেন দুর্বার গতিতে। শুধু ইয়াবা বিক্রি ও পাচার নয়, সোনার বার লুটসহ নানা অপরাধে ঝুঁকে পড়ছেন চট্টগ্রাম পুলিশের কিছু সদস্য। মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের লোভে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে দুই দশকে (২০০১ থেকে ২০২১) পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে ১৯টি ইয়াবাসংক্রান্ত। এরপর সোনার বার লুটের মামলা ১০টি। এ ছাড়া টাকা লুটের ৩টি, ডাকাতি ও খুনের ২টি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ২টি এবং অস্ত্র ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে আছে ২টি মামলা।
মামলায় আসামি ৫৩ জন। এর মধ্যে একজন করে পুলিশ সুপার (এসপি), সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) ও পরিদর্শক রয়েছেন। এ ছাড়া উপপরিদর্শক (এসআই) ২৪ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ৭ জন ও বাকি ১৯ জন কনস্টেবল। অপরাধে অভিযুক্ত ৪৩ জন পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে এক এসপিসহ সাতজন। বাকিরা জামিনে। এ পর্যন্ত তিন মামলায় সাবেক সাত পুলিশ সদস্যের সাজা হয়েছে।
পুলিশের কিছু সদস্য কেন ইয়াবা পাচারসহ নানা অপরাধে ঝুঁকছেন? ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে ইয়াবা পাচার হয়। ইয়াবা অনেকটাই সহজলভ্য। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে অবৈধভাবে সোনা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ধরাও পড়ে। অবৈধভাবে আসা সোনার বারগুলো লুট হলেও ক্রেতা-বিক্রেতার বৈধতা না থাকায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের জন্য সহজ পথ মনে করা হয় ইয়াবা পাচার ও সোনার বার লুট।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু পুলিশ সদস্য একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় পুলিশের অন্য সদস্যদের মধ্যেও অপরাধপ্রবণতা দেখা দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য পুলিশবাহিনীর আমূল পরিবর্তন দরকার। এ বাহিনীতে বর্তমানে কমিটমেন্ট ও রিসোর্সের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসে। কিন্তু সব অভিযোগই যে সত্য এটা সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে অর্ধলক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিন বিভাগে। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি নিশ্চিত করাই হলো অপরাধ দমনের প্রথম পদক্ষেপ। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
তাদের শাস্তি দুইভাবে হতে পারে জানিয়ে তারা বলেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় বিচার হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনক, দেশে কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার শাস্তি হয় কদাচিৎ। কখনো কখনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কোনো কোনো পুলিশ সদস্যকে ক্লোজ করা হয়। এ ক্লোজ করার অর্থ জেল, জরিমানা বা চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো কিছু নয়। এর অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে সাসপেন্ড করা। সাসপেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে আবার চাকরিতে বহাল করা হয়। চাকরিতে বহাল হওয়ার পর শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আবার নতুন উদ্যমে আগের মতোই তার অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যায়। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। অপরাধ জগতের দুর্বৃত্তদের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও একে একে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকলে একপর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৭
আপনার মতামত জানানঃ