সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডুবতে বসা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের একটি বড় অংশ বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল সম্পদ নিয়েও ট্রাস্টের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বড় অবদান রাখা দূরে থাক, বিপুল সম্পদ থেকে নিয়মিত ব্যয়ের টাকাই জোগাড় করতে পারে না ট্রাস্ট।
নগদ অর্থ আয়ের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। কিন্তু বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এবং দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধের মুখে। রিয়েল এস্টেটসহ সব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট।
বিপুল ভূ-সম্পত্তিসহ সব সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত নগদ টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে সৃষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। ট্রাস্ট এই ডিপোজিট করে রাখা টাকার সুদে চলবে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক।
ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ অবস্থা ও সম্ভাব্য বাজারমূল্য নির্ধারণ করে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাতে ভূ-সম্পত্তিসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।
এসব সম্পদ বিক্রির বিষয়ে সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তিনি তাতে সম্মতি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পুরো সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে নগদ টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখব। সেখান থেকে পাওয়া মুনাফা বা সুদ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।’
জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের স্থাবর-অস্থাবর জমি থেকে মাসে আয় হয় ২ কোটি ৬ লাখ টাকা। বিপরীতে ব্যয় প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত ব্যয়ের ঘাটতি মেটানো হয় ট্রাস্টের ১৯২ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত থেকে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে রাজধানীর টয়েনবি সার্কুলার রোডে পূর্ণিমা ফিলিং স্টেশনটি চলছে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। ৩২টির মধ্যে এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা এখনো সচল। অলাভজনক দেখিয়ে গেল বছর এই প্রতিষ্ঠানটিকেও ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি লোকসানে ছিল না কখনোই। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা উৎপাদনকারী তাবানী বেভারেজও বন্ধ হওয়ার পর ভাড়া দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, বর্তমানে মতিঝিলে ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়ের আংশিক, গুলিস্তান কমপ্লেক্স, পুরান ঢাকার মদনপাল লেনের মডেল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, তেজগাঁওয়ের সিরকো সোপ অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, মিমি চকলেট লিমিটেড, তেজগাঁও ও মিরপুরের তাবানী বেভারেজ, ঢাকার কলেজ গেটের মুক্তিযুদ্ধ টাওয়ার, চট্টগ্রামের বাক্সলী পেন্টস, ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, দেলোয়ার পিকচার্স, মাল্টিপুল জুস কনসেনট্রেট প্র্যান্ট এসব প্রতিষ্ঠানের জমি ও স্থাপনা ভাড়া দেওয়া রয়েছে।
এছাড়া ট্রাস্টের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের টাওয়ার একাত্তরের একাংশ এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের দুই খণ্ড জমি ভাড়া দেওয়া রয়েছে। এর মধ্যে তাবানী বেভারেজসহ ১০টি প্রতিষ্ঠানের জমি ও স্থাপনা ভাড়া দেওয়া হয় গত দুই বছরে। এছাড়া তেজগাঁও শিল্প এলাকার এক একর জমি ভাড়া দেওয়া হয় মাসে ১২ লাখ ২০ হাজার টাকায়। মিরপুরের সোয়া সাত একর ভাড়া দেওয়া হয়েছে মাসে ২৫ লাখ ২৬ হাজার টাকায়। ট্রস্টি বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া ট্রস্টের কোনো সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা (লিজ) দেওয়ার সুযোগ নেই।
জানা যায়, ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়ায় এখন পড়ে থাকা অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে কল্যাণ ট্রাস্ট। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা বিক্রয়যোগ্য সম্পদের তালিকাও তৈরি করেছে।
মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না থাকায় ট্রাস্টটি ডুবতে বসেছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাস্তবমুখী কল্যাণ নিশ্চিত করতেই মূলত দীর্ঘদিন পরে থাকা অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ট্রাস্টটি গঠন করেন। কথা ছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তার অধীনে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে আয় করবে এবং সেই আয় দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মসংস্থান ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে। এ উদ্দেশ্যে ওই সময়ে ‘লাভজনক’ মোট ১৮টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টের অধীনে দেওয়া হয়। পরে যোগ হয় আরও ১৪টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে।
ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা ছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ২২ ধরনের সুবিধা পান। এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছাত্রবৃত্তিসহ আট ধরনের সুবিধা ট্রাস্ট নিজের টাকায় দেয়। এসব সুবিধা দিতে গত অর্থবছরে ট্রাস্ট ব্যয় করেছে ৫ কোটি ১১ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে এখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের পরিচালনায় সচল আছে মাত্র ১টি প্রতিষ্ঠান। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠান কোকা–কোলা উৎপাদনকারী তাবানী বেভারেজও বন্ধ হওয়ার পর ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার এক বছরের মাথায়, ১৯৭২ সালে করপোরেট বডি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে উদারহস্তে বিপুল সম্পত্তিসহ রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের লাভজনক ১৮টি চালু শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টের হাতে ন্যস্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এর পাঁচ বছরের মাথায় মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে আরও ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টকে দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়।
পরে ট্রাস্ট একটি হাসপাতালসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে স্থাপন করে, যা চালুর কয়েক বছরের মাথায়ই বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে শুধু রাজধানীর টয়েনবি সার্কুলার রোডে পূর্ণিমা ফিলিং এন্ড সার্ভিস স্টেশন নামের ফিলিং স্টেশনটি চালু রয়েছে। এখান থেকে মাসে ৬ লাখ টাকা আয় হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রথম থেকেই বেভারেজ, ভোজ্য তেল, চকলেট, রাসায়নিক, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, গ্লাস ও অ্যালুমিনিয়াম, রাবারসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ব্যবসায় নেমেছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। এছাড়া তারা সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ ও ফিলিং স্টেশনও পরিচালনা করে।
কিন্তু নানা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় নগদ টাকা আয়ের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করা সম্পদশালী ট্রাস্টটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে জানান তারা।
১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ট্রাস্ট ত্রাণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন ছিল। পরের ১৯ বছর একে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়। ২০০১ সালে ট্রাস্টকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।
ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করার পর থেকেই লাভজনক কোম্পানিগুলো একে একে লোকসান করতে থাকে। এ কারণে ১৯৮১ সালে সরকার ট্রাস্টের সাতটি প্রতিষ্ঠানের ১৩ দশমিক ৮৪ একর জমি ও যন্ত্রপাতি মাত্র ১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়-দেনা মেটায়।
ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে সরকার ট্রাস্টের ১২৬ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণসহ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিলও মওকুফ করে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।
অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশের কারণে বেদখল হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করা হচ্ছে না, চালু মার্কেটগুলো থেকেও কাঙ্ক্ষিত আয় নেই। ফলে সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হচ্ছে ট্রাস্টকে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৫৮ একরেরও বেশি জমিসহ মোট ৬৬ একর জমির মধ্যে ট্রাস্টের দখলে আছে প্রায় ৬২ একর। বাকি জমি ট্রাস্ট্রের অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিভিন্ন লোক দখল করে মামলা করে রেখেছে। এসব বেদখল জমি উদ্ধারে কোনো তৎপরতা নেই।
এসব প্রতিষ্ঠান ধরে রেখে কোনো লাভ নেই জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতি ও লোকসানের কারণে শুধু ঢাকার একটি ফিলিং স্টেশন ছাড়া বিপুল জমিসহ প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কিছু লোক জমিগুলো দখল করে ১৮-২০ বছর আগে মামলা করে রেখেছে। সেসব মামলার কোনো শুনানিও হয় না। যেসব মার্কেটে ট্রাস্টের দোকান রয়েছে, সেখান থেকেও কাঙ্ক্ষিত আয় হচ্ছে না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব নয়। এ কারণেই আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সব সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না থাকায় ট্রাস্টটি ডুবতে বসেছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাস্তবমুখী কল্যাণ নিশ্চিত করতেই মূলত দীর্ঘদিন পরে থাকা অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘প্যাশন’ আছে, তাদের দায়িত্ব না দিলে অবস্থা এমনই হবে। ট্রাস্টের সব সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা স্থায়ী আমানত করে ব্যাংকে জমা রাখাও ভালো। এতেও মাসে এক শ থেকে দেড় শ কোটি টাকা আয়ের সুযোগ আছে।
তারা বলেন, দুর্নীতি আর অনিয়মে কেবল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েনি, দেশের এমন কোনো সংস্থা নেই যাতে দুর্নীতি আর অনিয়ম নামের কোনো ঘুণপোকা নেই। আশঙ্কার বিষয় এই যে, কবে না জানি দেশটাই অন্তঃসারশূন্য হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই আশঙ্কার বাস্তব চিত্র দেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ