নগদ অর্থ আয়ের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। কিন্তু বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এবং দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধের মুখে। রিয়েল এস্টেটসহ সব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট।
এদিকে সারা দেশেই মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব জমি কার বা কাদের দখলে রয়েছে, তা–ও অনেক ক্ষেত্রে ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের জানা নেই।
স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় কল্যাণ ট্রাস্টের নামে বরাদ্দ থাকা জমির আজ এমন দশা। এ অবস্থায় এসব জমি বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে না দিয়ে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে কল্যাণ ট্রাস্টের এসব সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, তারা কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানাধীন জমির স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেছেন, জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এসব জমি বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে দেওয়া হলে তা বেহাত হবে না। জনস্বার্থে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়ায় জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়, একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমির মূল্য ঠিক করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান শীর্ষস্থানীয় এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘আমরা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি রক্ষা করতে পারছি না। যে যেখান দিয়ে পারছে দখল করছে। যেমন রাজধানী সুপার মার্কেট আমাদের আয়ত্তে আছে বলে মনে হয় না। আমরা শুধু নামকাওয়াস্তে ভাড়া পাই। এ ছাড়া এসব সম্পত্তিতে যারা থাকে বা যাদের দখলে আছে, তাদের উচ্ছেদ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কেউ জায়গা খালি করে না। আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে।’
স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ট্রাস্টটি গঠন করেন। কথা ছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তার অধীনে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে আয় করবে এবং সেই আয় দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মসংস্থান ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে। এ উদ্দেশ্যে ওই সময়ে ‘লাভজনক’ মোট ১৮টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টের অধীনে দেওয়া হয়। পরে যোগ হয় আরও ১৪টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে।
ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা ছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ২২ ধরনের সুবিধা পান। এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছাত্রবৃত্তিসহ আট ধরনের সুবিধা ট্রাস্ট নিজের টাকায় দেয়। এসব সুবিধা দিতে গত অর্থবছরে ট্রাস্ট ব্যয় করেছে ৫ কোটি ১১ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
আমরা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি রক্ষা করতে পারছি না। যে যেখান দিয়ে পারছে দখল করছে।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে এখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের পরিচালনায় সচল আছে মাত্র ১টি প্রতিষ্ঠান। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠান কোকা–কোলা উৎপাদনকারী তাবানী বেভারেজও বন্ধ হওয়ার পর ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার এক বছরের মাথায়, ১৯৭২ সালে করপোরেট বডি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে উদারহস্তে বিপুল সম্পত্তিসহ রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের লাভজনক ১৮টি চালু শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টের হাতে ন্যস্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এর পাঁচ বছরের মাথায় মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে আরও ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টকে দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়।
পরে ট্রাস্ট একটি হাসপাতালসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে স্থাপন করে, যা চালুর কয়েক বছরের মাথায়ই বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে শুধু রাজধানীর টয়েনবি সার্কুলার রোডে পূর্ণিমা ফিলিং এন্ড সার্ভিস স্টেশন নামের ফিলিং স্টেশনটি চালু রয়েছে। এখান থেকে মাসে ৬ লাখ টাকা আয় হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রথম থেকেই বেভারেজ, ভোজ্য তেল, চকলেট, রাসায়নিক, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, গ্লাস ও অ্যালুমিনিয়াম, রাবারসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ব্যবসায় নেমেছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। এছাড়া তারা সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ ও ফিলিং স্টেশনও পরিচালনা করে।
কিন্তু নানা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় নগদ টাকা আয়ের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করা সম্পদশালী ট্রাস্টটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে জানান তারা।
ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করার পর থেকেই লাভজনক কোম্পানিগুলো একে একে লোকসান করতে থাকে। এ কারণে ১৯৮১ সালে সরকার ট্রাস্টের সাতটি প্রতিষ্ঠানের ১৩ দশমিক ৮৪ একর জমি ও যন্ত্রপাতি মাত্র ১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়-দেনা মেটায়।
ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে সরকার ট্রাস্টের ১২৬ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণসহ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিলও মওকুফ করে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।
অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশের কারণে বেদখল হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করা হচ্ছে না, চালু মার্কেটগুলো থেকেও কাঙ্ক্ষিত আয় নেই। ফলে সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হচ্ছে ট্রাস্টকে।
সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘যেভাবে কল্যাণ ট্রাস্টের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা সরকারি সংস্থার কাছেই এসব জমি বিক্রি করব। পড়ে থাকা এসব সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।’
গত ৪ মার্চ জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানান, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৯১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্থায়ী সম্পদ ১ কোটি ৬১ লাখ, বিনিয়োগ (এফডিআর) ২৩৪ কোটি ৭৫ লাখ ও চলতি সম্পদ ১৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ বিপুল সম্পদ নিয়েও ট্রাস্টের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। সম্পদশালী ট্রাস্টের জমি আছে প্রায় ৭০ একর। ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এই জমির বাজারমূল্য অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা। তবে সম্পদের তুলনায় আয় খুব সামান্য।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না থাকায় ট্রাস্টটি ডুবতে বসেছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাস্তবমুখী কল্যাণ নিশ্চিত করতেই মূলত দীর্ঘদিন পরে থাকা অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘প্যাশন’ আছে, তাদের দায়িত্ব না দিলে অবস্থা এমনই হবে। ট্রাস্টের সব সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা স্থায়ী আমানত করে ব্যাংকে জমা রাখাও ভালো। এতেও মাসে এক শ থেকে দেড় শ কোটি টাকা আয়ের সুযোগ আছে।
তারা বলেন, দুর্নীতি আর অনিয়মে কেবল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েনি, দেশের এমন কোনো সংস্থা নেই যাতে দুর্নীতি আর অনিয়ম নামের কোনো ঘুণপোকা নেই। আশঙ্কার বিষয় এই যে, কবে না জানি দেশটাই অন্তঃসারশূন্য হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই আশঙ্কার বাস্তব চিত্র দেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ