স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথম পর্যায়ে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৯১ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমান ও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী হিসেবে মোশতাকের নাম রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার(২৫ মার্চ) বিকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এই তালিকা প্রকাশ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের নাম।
তালিকায় ঢাকা বিভাগের বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৩৭ হাজার ৩৮৭ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে ৩০ হাজার ৫৩ জন, বরিশাল বিভাগে ১২ হাজার ৫৬৩ জন, খুলনা বিভাগে ১৭ হাজার ৬৩০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ হাজার ৫৮৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৩ হাজার ৮৯৯ জন, রংপুর বিভাগে ১৫ হাজার ১৫৮ জন, সিলেট বিভাগে ১০ হাজার ২৬৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
তৃণমূল থেকে যাচাই-বাছাইয়ের পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকার প্রথমটি প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেটা অপূর্ণাঙ্গই থাকছে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, প্রায় ৩৫ হাজার বেসামরিক গেজেট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অনুমোদন না থাকায় এ তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, এরইমধ্যে এসব গেজেট নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে আমরা ৪৩৪টি উপজেলার প্রতিবেদন পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই এবং আপিল শুনানি শেষে আগামী ৩০ জুনের (২০২১) মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় প্রকাশ পাবে।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে গ্যাজেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। নতুন করে আর কেউ মুক্তিযোদ্ধা আবেদন করতে পারবে না। যারা আগে আবেদন করে রেখেছেন তারা শুধু রিভিউ ও আপিল করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গণশহীদদের কীভাবে সম্মানিত করা যায় সেটা আমরা ভাবছি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সেনাবাহিনীসহ সকল বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা গ্যাজেট তালিকা ইতোমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গ্যাজেট প্রকাশটা বিতর্কিত ছিল। তবে তাদের ভাতা এখনও চালু আছে। বাহিনীর মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কারা যাচাই-বাছাই চলছে। আমাদের ধারণা ৮-১০ হাজার সঠিক মুক্তিযাদ্ধা হবে এবং ৫-৭ হাজার কোন যুদ্ধই করেনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘প্রকাশিত তালিকায় যদি কারও কোন তথ্যে মিল না থাকে তাহলে ভাতা পেতে বিভ্রান্ত হতে পারে। সেজন্য আমরা একবছর যাচাই বাছাই করেছি। শতভাগ নির্ভুল করার জন্য সময় নিয়েছি। তারপরও ভুল থাকতে পারে। তবে সেই ভুল তেমন বড় কোন কিছু হবে না।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দীর্ঘ ৯ মাস তাদের স্থানীয় দোসর জামায়াতে ইসলামি, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আল বদর, আলশামস ও শান্তি বাহিনীর সহায়তায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা এবং দুই লাখ মা-বোনের সন্ত্রমহানি করে। বীর বাঙালির হাতে পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে হত্যা করে এ দেশের সূর্যসন্তান, জাতির মেরুদণ্ড বুদ্ধিজীবীদের।
তিনি বলেন, আমরা ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করলেও তাদের কোনও তালিকা করতে পারিনি। বিলম্বে হলেও আমরা সেই তালিকা করা শুরু করেছি। দেশের প্রখ্যাত গবেষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরইমধ্যে কমিটি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। প্রথম ধাপে আমরা ১৯১ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করেছি। যাচাই- বাছাই শেষে ধাপে ধাপে আরও তালিকা প্রকাশ করা হবে।
সরকার ঘোষিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম পর্যায়ের তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমান ও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী হিসেবে মোশতাকের নাম রয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মন্ত্রী বলেন, ‘এই তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার নাম রয়েছে। জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাকের নামও তালিকায় রয়েছে। তবে এই দুই জনের নামের সঙ্গে তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ডের বিষয়েও লিপিবদ্ধ থাকবে।’
এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মদদদাতা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাবও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছিল। এনিয়ে তখন তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে মন্ত্রণালয়।
এবিষয়ে মন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান, মোসলেউদ্দীন, ডালিম, রাশেদ চৌধুরীরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এটি সত্য। কিন্তু তারা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে খুনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কেউ পরোক্ষভাবে কেউ প্রত্যক্ষভাবে। খন্দকার মোশতাক অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে। যা এখন আদালত স্বীকৃত। তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছিল। তিনি মারা যাওয়াতে আর বিচার হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এটি তো মিথ্যা নয়। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, এটি তার অর্জন। এটি বাতিল করা যায় না। কিন্তু খেতাব অন্যের দেওয়া। কোনও গুরুতর অপরাধের কারণে কর্তৃপক্ষ মনে করলে তা বাতিল করতে পারেন। যেমন, মিয়ানমারের সূচিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে নোবেল কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে রোহিঙ্গা বিষয়ে অমানবিক আচরণের কারণে নোবেল কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাহারের কথাও বলেছে। চাইলে কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাহার করে নিতে পারে বলেও জানান মন্ত্রী।
খন্দকার মোশতাকের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এটা অস্বীকার করা যাবে না। আবার তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যায় অভিযুক্ত। যেহেতু রায় প্রকাশের আগেই তিনি মারা যান তাই তার সাজা হয়নি। তবে তিনি তালিকায় থাকবেন।
রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করার বিষয়ে তিনি বলেন, রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। আমরা জামুকার আইন সংশোধন করে রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের কাজ করছি। আশা করছি, আগামী সংসদ অধিবেশনে আইনটি পাস হলে আমরা রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে পারবো।
স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে বারবারই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হলে নতুন করে প্রায় দেড় লাখ আবেদন আসে। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শেষ পর্যন্ত নতুন তালিকা প্রকাশ স্থগিত করতে হয় সরকারকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৪৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ