করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে যাচ্ছে৷ জাতীয় শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রম বলে গণ্য হয়। শিশুশ্রম দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ সমস্যা। অর্থনৈতিক দুরবস্থা শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে, যা গত চার বছরে বেড়েছে ৮৪ লাখ। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা, যে শিশুদের সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের কিছু বেশি। শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ২০১৬ সালের পর ৬৫ লাখ বেড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে ২০২২ সাল সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা না হয়, তাহলে এই সংখ্যা বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছাতে পারে।
কোভিড পরিস্থিতিতে পারিবারিক বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ এবং স্কুল বন্ধের কারণে ইতিমধ্যে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারগুলোতে কাজ হারানো বা আয় কমে যাওয়ার কারণে আরো অনেক শিশু শ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশ শিশুশ্রম বন্ধের ঘোষণা দিলেও , আমাদের দেশে এটি বেড়েই চলেছে। ফলে দিন দিন এই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। সচেতন মহল মনে করেন বাংলাদেশে শিশু শ্রমের অন্যতম কারণ হলো দারিদ্রতা। আর আমাদের দেশে ৩১ দশমিক ৬ ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। এসব পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু আয় দৈনিক ৮০ টাকারও কম। এদের বেশির ভাগ পরিবার অসচ্ছল। ফলে এসব পরিবারের শিশুরা তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য ছোট থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শুরু করে। তাই তাদের নিজেদের আর পরিবারের খাওয়ার জন্য শিশুরা লেখাপড়ার পরিবর্তে এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পিছপা হচ্ছে না।
এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে— মোটর ওয়ার্কশপে কাজ করা, ওয়েল্ডিং, গ্যাস কারখানা, লেদ মেশিন, রিকশা চালানো, বাস-ট্রাকের হেলপারি, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহশিশু শ্রমিক, ইটভাঙা, ইটভাটা শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, স্টিলের আলমারির দোকানের শ্রমিকসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ। ফলে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে ‘কোভিড-১৯-এর প্রভাবে ঢাকায় কর্মরত শ্রমজীবী শিশুদের অবস্থা যাচাই’ শীর্ষক জরিপ থেকে জানা যায়, করোনায় অনেক শিশুর পেশা পরিবর্তন হয়েছে। আগে কাজ করত এমন ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর এখন কাজ নেই। আর এমন ৩১ শতাংশের ওপর তাদের পরিবার নির্ভরশীল। এদের মধ্যে ৩২ শতাংশ শিশু মহামারিতে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্যও পায়নি।
কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে যাচ্ছে। তবে সারা দেশে কত শিশু বর্তমানে স্কুল ছেড়ে কাজে নেমেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নিয়মিত ৩১ হাজার শিশুকে মনিটরিং করে। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার শিশুকে সংগঠনটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে স্কুলে নিয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৩ হাজার শিশু আবারও স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে গেছে।
কোভিড পরিস্থিতির কারণে ২০২২ সাল সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা না হয়, তাহলে এই সংখ্যা বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছাতে পারে।
এ ছাড়া কিডসরাইটসের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে গৃহীত নানা বিধিনিষেধের কারণে বিশ্বে কোটি কোটি শিশু শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। কিডসরাইটসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মার্ক ডুলেয়ার্ট বলেন, করোনা মহামারি শিশুদের ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তা আমাদের অনুমান ছাড়িয়ে গেছে।
শিশুশ্রম বন্ধে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এডুকো বাংলাদেশ। এ সংস্থার ‘অধিকার’ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আফজাল কবির খান জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে নগরে গৃহস্থালি কাজে এবং পরিবহন খাতে নিযুক্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এডুকো বস্তি অঞ্চলে তিনটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০০ শ্রমজীবী শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি চালু করার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে ৩০০ শ্রমজীবী শিশুর মধ্যে ১৪৬ শিশুকে সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসে। তবে করোনাকালে তাদের পরিবারের অভিভাবকরা কর্মসংস্থান হারালে এই শিশুদের অনেকেই আবার বিভিন্ন ধরনের পেশায় যুক্ত হয়েছে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৩ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমের সাথে যুক্ত। অন্যদিকে গবেষণায় জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্রের হার ১ শতাংশ বৃদ্ধি শিশুশ্রমের কমপক্ষে ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটায়। করোনা মহামারিতে আমাদের দেশের প্রায় ২.৫০ কোটি মানুষ নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছে। ফলে এই দরিদ্রতার সাথে সাথে শিশুদের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ফলে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুরা এখন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা সরকারের হাতে আছে কিনা জানা নেই। তবে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা যদি শিশুশ্রমে একবার নিয়োজিত হয়ে যায় তবে আগামী দশকে শিক্ষার হার নিম্নমুখী হবে। ফলে বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু শ্রম সম্পূর্ণ নির্মূল করার কর্মসূচী পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে। এর ফলে সমাজের একাংশ জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে ছিটকে যাবে।
এমন এক পরিস্থিতিতে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ ও অধিকার নিশ্চিত করতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ সোমবার বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২১। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ি’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ উপলক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সপ্তাহব্যাপী সারাদেশে নানা কর্মসূচি পালন করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতিতে শিশুরা তাদের অধিকার হারিয়েছে। শ্রমিক হিসেবে শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। মহামারির আগেও দেশে বিভিন্ন সেক্টরে উল্লেখ্যযোগ্য শিশুশ্রমিক থাকলেও তারা সরকারি বা এনজিও পরিচালিত স্কুলে যেত। কিন্তু মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারে আর্থিক অনটনের কারণে দরিদ্র এই শিশুরা পুরো সময় কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এখন তাদের পক্ষে আর স্কুলে ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক ও শ্রম বাজারে ধাক্কা, মানুষের জীবিকার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলছে৷ দুর্ভাগ্যবশত এই সংকট শিশুদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ দারিদ্রের কারণে শিশুদের নামতে হচ্ছে কাজে৷ করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তাদের সন্তাদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে৷ কারণ অনেক অভিভাবকেরই মোবাইল ডাটা কিনে সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানোর সক্ষমতা নেই৷
তারা বলছেন, শিশুশ্রমবিষয়ক সব নীতি ও আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)-এ ‘হালকা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত করা এবং আইন লঙ্ঘনের শাস্তি সুস্পষ্ট করা দরকার। গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার সঙ্গে মা-বাবা এবং অভিভাবকদের শিশুশ্রমের নেতিবাচক দিক বোঝানো প্রয়োজন। গৃহকর্মসহ সব খাতে শিশুদের নিয়োজিত করার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা জরুরি। শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
আরও বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময় যে বিষয়গুলোতে জোর দিলে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা যাবে তা হলো সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা এবং শিশুদের নিরাপদে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো এবং পরিদর্শন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
শিশু শ্রমিকদের বেদনার কথা বলা যথেষ্ট নয়; শিশুশ্রম নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ সমাজের সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৩
আপনার মতামত জানানঃ