মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে, যা তার পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে ৪২ গুণ বেশি। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুসারে ক্ষতি হয়েছে ১৪৭.৬ কোটি টাকা যেখানে তার পরিশোধিত মূলধন ৩.৫ কোটি টাকা। খবর দ্য বিজনেস পোস্ট
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানির কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে।
বিএসইসি সম্প্রতি নগদের আর্থিক বিবৃতিতে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ করেছে। বিএসইসি কর্তৃক উন্মোচিত ঘাটতি অনুসারে, কোম্পানির উদ্ধৃত্ত আয়ে ৩২৪ কোটি টাকা ঘাটতি যেখানে বিবৃতি অনুসারে এর মোট ইকুইটিও ২৫২.২ কোটি টাকা ঘাটতি।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট, কোম্পানির উদ্বৃত্ত ও মুনাফায় ব্যাপক ঘাটতি থাকা সত্বেও কিছু শর্ত পূরণের চুক্তিতে জিরো কুপন বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে কমিশন থেকে ৫১০ কোটি টাকার অনুমোদন পেয়েছিল নগদ। শর্ত অনুযায়ী, নগদকে বন্ডের ট্রাস্টি ডিড রেজিস্ট্রেশন, ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো থেকে এর সকল পরিচালকদের ছাড়পত্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সনদ জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, বন্ড অনুমোদিত হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত সম্মতি এখনও দেওয়া হয়নি।
বিএসইসির আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এমএফএস প্রদানকারী তার প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে উল্লিখিত বন্ড জারির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের বিষয়ে এনওসি জমা দেয়নি যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিধি, ২০২১ এর নিয়ম ৯(২) অনুযায়ী জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি বলেন, নগদ আর্থিক হুমকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কারণ এর উপার্জন এবং লাভের মাত্রা অত্যন্ত অসন্তোষজনক।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, পরিচালনা কার্যক্রম থেকে কোম্পানির নীট নগদ প্রবাহ ‘পরোক্ষ পদ্ধতি’ দ্বারা গণনা করা হয় এবং সেজন্য কোম্পানির তারল্য সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না।
পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, ডিজিটাল অর্থের জন্য নগদের দায় অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে। গত বছরের জুনে ৪৪৭.১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে চলতি বছরের এপ্রিলে ৮৫৮.১ কোটি টাকা হয়ে গেছে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ৪১১ কোটি টাকার বর্ধিত দায় নীট পরিচালনার নগদ প্রবাহকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
কোম্পানির ব্যাপক লোকসান সম্পর্কে নগদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাহেল আহমেদ বলেন, ‘এই ধরনের কোম্পানি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে লাভ দেখবে’।
বিএসইসি পর্যবেক্ষণ অনুসারে, সংস্থার প্রধান কাজ মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদান করা, কিন্তু জমা দেওয়া স্মারকলিপি এবং আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন (এওএ) অনুযায়ী কোম্পানি এমএফএস প্রদান করতে পারে বা পেমেন্ট পরিষেবা প্রদানকারী হিসাবে কাজ করতে পারে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
বিএসইসির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি তার পরিচালনা পর্ষদের সিআইবি ক্লিয়ারেন্স রিপোর্ট জমা দেয়নি, যা ১ জুলাই, ২০২১-এ রদবদল করা হয়েছিল এবং তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি)-কে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল।
বন্ড অনুমোদনের জন্য নগদ কর্তৃক বিএসইসিতে জমা দেওয়া নথি অনুসারে দেখা গেছে যে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ১ জুলাই, ২০২১ তারিখে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সংস্থাটি আরজেএসসির প্রত্যায়িত হালনাগাদ হস্তান্তর করেনি। অতএব কোম্পানির পরিচালক, স্পনসর এবং সিইওর জন্য সর্বশেষ সিআইবি ছাড়পত্র রিপোর্ট সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
কোম্পানিটি বাংলাদেশ ডাকঘরের লোগো ব্যবহার করছে কিন্তু কোম্পানির শেয়ারহোল্ডিং অবস্থান অনুযায়ী, কোম্পানি এবং বাংলাদেশ ডাকঘর বা ডাক কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই বলে মনে করছে বিএসইসি। এমনকি পোস্টাল লোগো ব্যবহারের জন্য কোম্পানি ডাক কর্তৃপক্ষকে কোন রয়্যালটি প্রদান করেনি।
এদিকে নগদের সঙ্গে ডাক বিভাগের অংশীদারত্বের বিষয়ে রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) এক ভিডিও বার্তায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. আফজাল হোসেন বলেছেন, ‘নগদ’ প্রধানমন্ত্রী স্বীকৃত একটি আর্থিকসেবা। এটি সবাই জানে যে, প্রধানমন্ত্রী নগদের এ সেবাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তিনি নিজে ১০ হাজার টাকা দিয়ে এটির লেনদেন শুরু করেন। কাজেই এ ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি রয়েছে।
সচিবের আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সিরাজ উদ্দিনও পৃথক বার্তায় নগদের মালিকানা নিয়ে অপপ্রচারকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘নগদ’ ডাক বিভাগের সেবা। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।
এরই ধারাবাহিকতায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. আফজাল হোসেন বলেন, ডাক বিভাগ ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ‘নগদ’ সেবার মাধ্যমে। সময়ের পরিক্রমায় নানা চড়াই-উৎরাই পার করে ২০২১ সালে ‘নগদ’ ভালো একটি পর্যায়ে চলে এসেছে। ‘নগদ’ জনগণের সেবায় ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখবে এবং এক সময় ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন সচিব।
তিনি বলেন, দেশে যেসব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস চালু রয়েছে, ‘নগদ’ এর মধ্যে একটি অন্যতম সার্ভিস। নগদের গ্রাহক সংখ্যা ও মুনাফা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সচিব বলেন, নগদের সামনে যেসব বাধা বা অসুবিধা রয়েছে সেগুলো অতিক্রম করে আগামী দিনে এটি একটি পরিপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ টেকনোলজিক্যাল সার্ভিস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বর্তমানে আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে আছি। শিগগির ‘নগদ’ প্রথম স্থানে থেকে দেশ ও জনগণের সেবা দিতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
২০১৯ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নগদ’র সেবার উদ্বোধন করেন। গত আড়াই বছরে ‘নগদ’ সাড়ে পাঁচ কোটি গ্রাহক পাওয়ার পাশাপাশি দৈনিক গড় লেনদেন ৭০০ কোটি টাকা পেরিয়ে গেছে। সরকারি ভাতা-উপবৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা বিতরণে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার ব্যবহার করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নগদ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৪
আপনার মতামত জানানঃ