একসময় গবাদী পশুর মতোই হাটে-বাজারে কেনাবেচা হতো মানুষ। দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতো তাদের। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ্ব থেকে পুরো দুনিয়ায় দাস ব্যবসা বিলুপ্ত হতে শুরু করলেও, দাসপ্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। দাসপ্রথা বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল এই বাংলা তথা উপমহাদেশেও। ১৮৬২ সালের হিসাবে আসামে ২৭,০০০ ও চট্টগ্রামে ১,২৫,০০০ দাস ছিল। দাম ছিল গড়ে কুড়ি টাকা। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দাস ছিল এখানকারই নিজস্ব অধিবাসী। কিছু বিদেশি ক্রীতদাসও আসত। কলকাতাতে প্রতিবছর আসত প্রায় ১০০ ভিনদেশি দাস। ১৮৩০ সালের এক সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অযোধ্যার নবাব চড়া দামে কিনেছিলেন ৫ জন সুন্দরী বিদেশি মেয়ে আর ৭ জন ভিনদেশী পুরুষ। দাম পড়েছিল কুড়ি হাজার টাকা।
দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে প্রচলিত ছিল দাস ব্যবসা। দাস ব্যবসার সবথেকে কদর্য রূপটি দেখা যায় মধ্যযুগে ‘ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসায়। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর দিনটাকে মানবজাতির ইতিহাস বদলে দেওয়া একটা দিন বলা যেতে পারে। ওইদিন ভারতের মাটিতে পৌঁছেছেন মনে করে আমেরিকা মহাদেশের মাটিতে পা রাখেন নাবিক কলম্বাস ও তার সঙ্গীসাথীরা। এরপর থেকেই সদ্য আবিষ্কৃত মহাদেশটিতে দলে দলে ছুটে আসতে শুরু করে ইউরোপীয়রা। ইউরোপ তখন প্লেগ ও কুসঙ্কারে আচ্ছন্ন; আবাদি জমির অভাব সেখানে। তাই এই সুযোগে ইউরোপীয়রা স্থানীয় আদিবাসীদের থেকে বিভিন্ন কৌশলে দখল করতে লাগল তাদের জমি। সেই উর্বর জমি ইউরোপীয়দের কাছে সোনার খনির থেকে মূল্যবান।
অন্য মহাদেশে হানা দিয়ে কালো মানুষদের ধরে শেকলে বেঁধে জাহাজ বোঝাই করে গরু-ছাগলের মত বিক্রি করে; আমেরিকার আদিবাসি রেড ইন্ডিয়ানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, বেপরোয়া গুলি চালিয়ে হাজার হাজার রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে তাদের জমি ও দেশ দখল করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়রা অন্ধকার থেকে আলোতে পৌঁছায়!
দখলদারিত্বকে স্থায়ী করতে আমেরিকায় একই সাথে ইউরোপীয়রা শুরু করে ব্যাপক কৃষিকাজ এবং স্থানীয়দের উপর অত্যাচার। কিন্তু বিশাল এই দুটি মহাদেশের হাজার হাজার মাইল অনাবাদি জমি আবাদ করার মত জনবল তাদের ছিলনা। আর এই সমস্যা সমাধান করতে শুরু হয় ইতিহাসের কালো এক অধ্যায়।
আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মানুষকে দাস হিসাবে ধরে আনা হয়। আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ আমেরিকায় দাস ধরে আনার এই ব্যবসাই ইতিহাসে ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড হিসাবে পরিচিত।
ষোড়শ শতকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া এই দাস ব্যবসা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ধরে চলতে থাকে। আফ্রিকার প্রায় দেড় থেকে দুই কোটির মত নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল। যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই নিয়ে আসার সময় অত্যাচারে, ক্ষুধায়, পিপাসায় ও রোগ শোকে মারা পড়েছিল সমুদ্র পথে। প্রায় ৮০ লাখের মত দাস আনা হয়েছিল শুধু ব্রাজিলেই, আর ৪০ লাখ যুক্তরাষ্ট্রে; বাকিদের হাইতি ও ক্যারিবীয় অন্যান্য দ্বীপগুলোতে পাঠানো হয়েছিল।
স্প্যানিশ জাহাজে ১৫০২ সালে ইউরোপ থেকে দাস বোঝাই প্রথম জাহাজটি আমেরিকায় পৌছায়। প্রথম দিকে পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশদের হাতেই ছিল দাস ব্যবসার কলকাঠি। এরপর ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স সমানতালে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। মূলত দাস ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিল পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল যেটা সেনেগাল থেকে অ্যাঙ্গোলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দাস ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো ছিল বেনিন, টোগো এবং নাইজেরিয়ার পশ্চিম উপকূলে। তাই এই এলাকাগুলোকে স্লেভকোস্ট বা দাসের উপকূল বলা হত।
যুদ্ধবন্দী, অপরাধী, ঋণগ্রস্ত ও বিদ্রোহীদেরকে স্থানীয় আফ্রিকানদের কাছ থেকে দাস হিসাবে কিনে নিত ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অনেক সাধারণ মানুষকেও দাস ব্যবসায়ীরা অপহরণ করে দাস হিসাবে বেচে দিত। মোট ৪৫টির ছোট বড় জাতিগোষ্ঠী থেকে দাস ধরে আনা হত। এদের বেশির ভাগই ছিল আদিবাসী বা আফ্রিকার স্থানীয় সংস্কৃতির অনুসারী।
দাসদের ধরে আনার সময় অসংখ্য মানুষ মারা পড়ত সমুদ্র পথে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময়। জাহাজগুলোতে থাকত না স্যনিটেশনের ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত খাবার। খরচ বাচানোর জন্য গাদাগাদি করে মানুষ উঠানো হত জাহাজে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিত হত আমেরিকায় নিয়ে আসার পর। সেখানকার সিজনিং ক্যাম্পগুলোতে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দাস মারা পড়ত ডায়রিয়া ও আমাশয়ে। অনেকে এই অপমানের গ্লানি থেকে বাঁচতে পালানোর সময় মারা পড়ত কেউবা করত আত্মহত্যা।
ওই সময়ে দাসরা বিবেচিত হত মালিকের সম্পত্তি হিসাবে। যদিও সুদূর অতীত থেকেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে; তবে কোথাও অমানবিকতা আমেরিকান দাসপ্রথাকে অতিক্রম করতে পারেনি। আমেরিকান ভূমি মালিকদের কাছে দাসরা ছিল কেবল কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র।
শিল্পবিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপীয় কলোনিগুলোর অর্থনীতি ছিল দাস নির্ভর। তবে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দাস ব্যবসার অর্থনৈতিক আবেদন কমে যেতে থাকে। তাই উনবিংশ শতক থেকে বিভিন্ন জায়গায় দাবি উঠতে থাকে দাস প্রথা বিলোপ করার। এ দাস প্রথা থেকেই মূলত কলোনিয়ালিজমের উত্থান। দাস ব্যবসার ফলে আফ্রিকায় মানব শক্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে উনবিংশ শতকে ইউরোপীয় কলোনিয়াল শক্তিগুলো একে একে দখল করতে লাগল আফ্রিকার দেশগুলো।
রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস প্রথা সর্বপ্রথম বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইংল্যন্ড ১৮০৭ সালে। তারপর একে একে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হতে থাকে দাস ব্যবসা। সর্বশেষ দেশ হিসাবে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছিল ব্রাজিল ১৮৩০ সালে। তবে অবৈধ দাস ব্যবসা বন্ধ হতে ১৮৬০ এর দশক পর্যন্ত সময় লাগে। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ মিলিয়ন। আমেরিকার উত্তরাংশে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম গ্যারিসন, ‘আংকল টমস কেবিন’ এর লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো প্রমুখের নেতৃত্বে।
১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন। লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়।
১৭ শতকের এই ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসার অন্যতম শিরোমণি ছিলেন এডওয়ার্ড কুলস্টন। সেই সময় তার রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানি আমেরিকায় ক্রীতদাস পাচারে ব্যবসায় ছিল সবার উপরে। তার দাস ব্যবসার ধনসম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছিল ব্রিস্টল শহর। সেখানে বীরের মর্যাদায় নির্মাণ করা হয়েছিল তার স্মারক ভাস্কর্য। ক্রীতদাস কোম্পানিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল রাজপরিবারগুলো। রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানি বা ইংলিশ মার্কেন্টাইল কোম্পানির পেছনে ছিল স্কটল্যান্ডের রয়্যাল স্টুয়াট পরিবার ও ডিউক অব ইয়র্কের মতো রাজপরিবারগুলো।
মানব ইতিহাসের সর্বাধিক অমানবিক নির্মমতার উপাখ্যান এই ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, স্বাধীনতা তার জন্মগত অধিকার। লোভী ইউরোপীয় বেনিয়াদের খপ্পরে পড়ে কোটি কোটি আফ্রিকানের জীবন ও স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তাই মানব ইতিহাস জানতে হলে এই দাসেদের কথাও আমাদের জানতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২৪
আপনার মতামত জানানঃ