বর্ষাকাল এলেই পাহাড়ধসের দুর্ঘটনায় ঘরবাড়ি হারানো এবং মৃত্যু দুটিই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা যখন স্বাভাবিক হয়ে যায় তখন এর পেছনে দীর্ঘ অনিয়ম দায়ী। পাহাড়ধসে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি হলে নিয়মমাফিক তৈরী হয় তদন্ত কমিটি। এসব কমিটি নানা সুপারিশও করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সেসব সুপারিশের বেশির ভাগই কাগজে থাকে, বাস্তবায়ন হয় না। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের নামের তালিকার কাজও অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
অন্যদিকে পাহাড়ধস রোধে প্রযুক্তিগত দিকও রয়েছে। ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের বিষয়ে আগাম বার্তা দেওয়ার যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা মানুষকে সতর্ক করার কার্যকর একটি উপায়। ১১ বছর আগে পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চার এলাকায় স্থাপন করা যন্ত্রগুলোও এখন নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো ঠিক করার চেষ্টাও নেই।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) ও আজ বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) কক্সবাজারে পাহাড়ধসে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ৬ জন রোহিঙ্গা।
চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির পাহাড়ধসের পর সরকারের গঠন করা দুটি বড় বিশেষজ্ঞ কমিটিতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘জুন-জুলাই-আগস্ট—এ তিন মাসে পাহাড় ধস হলে আমরা বক্তব্য দেব, আপনারা কলম ধরবেন আর সরকারও নড়াচড়া করবে। এটাই হয়ে আসছে। এ ছাড়া কিছু হয় না।’
পাহাড়ধসে গত ২০ বছরে পাঁচ শতাধিক মৃত্যু
গত ২০ বছরে দেশে পাঁচ শতাধিক মানুষ মারা গেছে পাহাড়ধসের কারণে। ‘ডিজাস্টার রিস্ক গভর্ন্যান্স ফর ডিস্ট্রিক্ট-লেভেল ল্যান্ডস্লাইড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণাটি করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ইদ্রিস আলম। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন সাময়িকীতে চলতি বছর এ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
গত দুই দশকের মধ্যে ২০০৭ সালের জুনে চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। আর তার এক দশক পরেই ২০১৭ সালের ১২ থেকে ১৩ জুন পার্বত্য তিন জেলাসহ ছয় জেলায় পাহাড় ধসে ১৬৮ জন নিহত হন। ১৩ জুন পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে নিহত হন ১২০ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে পাহাড় ধসে এত প্রাণহানি আগে হয়নি।
পাহাড়ধস বৃদ্ধির অন্যতম কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থী
ভূ-প্রকৃতির নিয়ম না মানলে তার খেসারত দিতেই হয়। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে অনেক পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক জায়গায় পাহাড়ের চূড়া, মধ্যবর্তী অংশ ও পাদদেশে ঝুঁঁকি নিয়ে বাস করছে হতদরিদ্র মানুষ।
পাহাড়ধস রোধে প্রযুক্তিগত দিকও রয়েছে। ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের বিষয়ে আগাম বার্তা দেওয়ার যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা মানুষকে সতর্ক করার কার্যকর একটি উপায়। ১১ বছর আগে পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চার এলাকায় স্থাপন করা যন্ত্রগুলোও এখন নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো ঠিক করার চেষ্টাও নেই।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার পর পাহাড়ে বসতির সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে যায়। পাহাড়ের পাদদেশে এসব বসতি যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে, তেমনি তৈরি করেছে পরিবেশগত বিপর্যয়।
পাহাড়ে বসতি নির্মাণ চিরতরে বন্ধ করা না গেলে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাই এখনই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। সল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুই রকম উদ্যোগ নিয়েউ প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা তৈরীর কাজও অসমাপ্ত
রাঙামাটিতে পাহাড়ধসের পর পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে রাঙামাটির পাহাড়ধসের পর গঠিত কমিটি কক্সবজার ও চট্টগ্রামের পাহাড়ধস এবং মৃতুরোধেও সুপারিশ করে। এসব সুপারিশের মধ্যে একটি ছিল তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা তৈরি করা। এই কাজও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি শেষ করা যায়নি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, জেলার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের কোনো ডেটাবেইস (তথ্যভান্ডার) তাদের হাতে নেই।
পাহাড়গুলোর ধারণক্ষমতা ও আবাসসক্ষমতা বিবেচনা করে শ্রেণিবিন্যাস করার সুপারিশও করা হয়েছিল। ভারী বর্ষণের আগে যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বার্তা দেওয়া যায়, সে জন্য একটি অ্যাপ তৈরির পরামর্শ ছিল। এসবের কিছু হয়নি।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঐ জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘বৃষ্টি হলে একটি আতঙ্ক কাজ করে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে থাকা মানুষকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করি। সম্প্রতি কক্সবাজারে যে ধারায় বৃষ্টি হয়েছে, তা রাঙামাটিতে হলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেত।’
পাহাড়ধসের আগাম বার্তা দেয়া যন্ত্রও নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে দিনের পর দিন
পাহাড়ধসে সুপারিশগুলোর বাস্তাবায়ন তো হচ্ছেই না, উল্টো দেশের চারটি স্থানে স্থাপন করা পাহাড়ধসের আগাম বার্তা দেওয়ার চারটি যন্ত্র (রেইন গজ) অকেজো হয়ে গেছে। এসব যন্ত্র ২০১০ সালে স্থাপন করেছিল ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম শহর, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ উপজেলা—এ চার জায়গায় মোট চারটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির পরিমাণ দেখে পাহাড়ধসের আগাম বার্তা দেওয়া যেত।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক (ভূতত্ত্ব) সালমা আক্তার বলেন, ‘এ বছর বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার পর যন্ত্রগুলো থেকে আর বার্তা পাওয়া যায়নি। অনেক দিন আগের যন্ত্র। এগুলো পাল্টানো দরকার। কিন্তু তা আর হয়নি।’ যন্ত্রগুলো যে নষ্ট হয়ে গেছে, তা জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছিল বলে জানান তিনি।
যে চারটি স্থানে যন্ত্র আছে, সেখান থেকে স্থানীয় প্রশাসনসহ ১০টি জায়গায় আগাম বার্তা দেওয়া হতো। উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওরাও বার্তা পেতেন। তবে এবার পাহাড়ধসের আগে এমন কোনো বার্তা পাননি বলে জানান টেকনাফের ইউএনও পারভেজ চৌধুরী।
পাহাড়ধসে এত প্রাণহানি হবার পরেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তা রোধে কর্যক্রমের বিষয়ে। বাংলাদেশের পাহাড়ধস বড় রকমের বিপত্তি ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২০১২
আপনার মতামত জানানঃ