বর্ষাকাল এলেই পাহাড়ধসের দুর্ঘটনায় ঘরবাড়ি হারানো এবং মৃত্যু দুটিই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা যখন স্বাভাবিক হয়ে যায় তখন এর পেছনে দীর্ঘ অনিয়ম দায়ী। পাহাড়ধসে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি হলে নিয়মমাফিক তৈরী হয় তদন্ত কমিটি। এসব কমিটি নানা সুপারিশও করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সেসব সুপারিশের বেশির ভাগই কাগজে থাকে, বাস্তবায়ন হয় না। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের নামের তালিকার কাজও অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে দিন দিন অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বাড়ছে। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা এসব বসতিতে মূলত ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের লোকজনের বসবাস। তবে এই পাহাড় দখলের নেপথ্যে রয়েছেন অনেক রাজনীতিক।
অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি ও বস্তি তৈরি করে এসব কম টাকায় ভাড়া দেয় প্রভাবশালীরা। সেই অবৈধ ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ থাকায় নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষেরা ওইসব ঘরে ভাড়া থাকছেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাস রোধ করতে না পারার কারণে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব ফিরোজশাহ এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিলে বসতির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। রেলওয়ের পাহাড়ে এই বসতি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এই তিনটি ঝিলের মহল্লা কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন নুরুল ইসলাম। তিনি স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
এই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল ইসলাম। পাঁচ বছর আগে তিনি ১ নম্বর ঝিল বহুমুখী সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মূলত জহুরুলই ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের অবৈধ বসতিগুলোর মূল নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিনটি ঝিলের পাশে জিয়া নগর, মুজিব নগর ও বিজয় নগর নামে আরও তিনটি পাহাড়ে অবৈধ বসতি রয়েছে। এখানেও বসতির সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। এসবের নিয়ন্ত্রণও জহুরুলের হাতে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১ নম্বর ঝিলে অবৈধ বাসিন্দাদের সুবিধার্থে তিনি সিটি করপোরেশনের সহায়তায় আরসিসি ঢালাই করে রাস্তা নির্মাণ করে দেন
জানা গেছে, রেলওয়ের পাহাড় দখল করে এখানে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। দখলস্বত্ব বেচাকেনা হয় এক থেকে পাঁচ লাখ টাকায়। ঝিলের শেষ মাথায় ১৭ জুন ফজল হকের যে বাসায় পাহাড়ধস হয়েছে, সেখানে তারা বসবাস করছিলেন ১৫ বছর ধরে।
চশমা পাহাড়ের গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকার পাশে যে পাহাড়ধস হয়েছে, তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন। তার বিরুদ্ধে সেখানে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। তাদের কিছু ভাড়াঘরও রয়েছে পাহাড়ের খাঁজে।
চট্টগ্রামের ৩৪টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে মৃত্যুকে সঙ্গী করে বাস করছেন প্রায় এক লাখ মানুষ। যারা নগরে এসে মাথা গোজার ঠাঁই পায়না, এমন দরিদ্র পরিবারগুলো সস্তায় বাসা ভাড়া নেয় পাহাড়ে।
২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানি পর বিপর্যয় ঠেকাতে তদন্ত কমিটিগুলো মোট ৭২ টি সুপারিশ করে; যার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি গত ১৫ বছরে। এক যুগ আগে যে শবযাত্রা শুরু হয়েছিল এ পর্যন্ত তা ২০৯ জনে গিয়ে ঠেকেছে।
সম্প্রতি আকবর শাহ থানার বরিশাল ঘোনা ১ নম্বর ঝিল পাড় এলাকায় পাহাড় ধসে দুই বোন নিহত হন। আহত হন তাদের মা-বাবা। এছাড়া বিজয় নগর এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হন আরও দুইজন। নিহতদের সবাই দরিদ্র পোশাক শ্রমিক।
এ মর্মান্তিক ঘটনার পর সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বারবার বলার পরও পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনকারীরা সরেনি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ে মৃত্যুর ওই ফাঁদ সেবা সংস্থাগুলোরই তৈরি করা।
অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি ও বস্তি তৈরি করে এসব কম টাকায় ভাড়া দেয় প্রভাবশালীরা। সেই অবৈধ ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ থাকায় নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষেরা ওইসব ঘরে ভাড়া থাকছেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাস রোধ করতে না পারার কারণে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বাস করছে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১; বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সরকারি সাত পাহাড়ে এ সংখ্যা ৩০৪।
তবে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নগরীর লালখান বাজার, মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, পাহাড়তলি, কৈবল্যধাম, খুলশী, বায়েজিদ, আকবর শাহ, জঙ্গল ছলিমপুরসহ নগরের ৩৪ পাহাড়ে কয়েক হাজার পাকা, সেমি পাকা ও কাঁচা স্থাপনায় বর্তমানে অবৈধ বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি।
সম্প্রতি ফয়’স লেকে পাহাড়ধসের যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে; সেখানকার পাহাড়গুলো সরকারি মালিকানাধীন। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে ওই কলোনি। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার সিন্ডিকেট এই কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। সেবা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় ওইসব অবৈধ বস্তিতে দেওয়া হয়েছে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ।
পাশের এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে পাকা ঘরও; যেখানে ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি এলাকায় দেখা গেছে গ্যাস সংযোগও। মূলত অল্প খরচে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সুবিধা থাকায় এসব মৃত্যুকূপে ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছেন।
শুধু মাত্র পূর্ব ফিরোজশাহ এলাকায় রেলের ৩৩৬ দশমিক ৬১ একর জমি দখলে নিয়েছেন ৩০০ দখলদার। এদের নিয়ন্ত্রণে বাস করে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই এলাকার পাহাড়ের ঢালে এক কাঠা জমি ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আর পাহাড়ের নিচে প্রতি কাঠা ২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। জাল স্ট্যাম্পে চলে এসব পাহাড়ের কেনাবেচা।
রেলওয়ের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পাহাড়ে তিন হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। অনেকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও মামলাসহ নানা কারণে করা যায়নি। স্থানীয় একটি সুবিধাভোগী পক্ষ আছে। তারা এসব বাসিন্দার শেল্টার দেয়। নইলে কি এত বড় সরকারি জায়গা দখল করা ছিন্নমূলদের পক্ষে সম্ভব?’
অবৈধ দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এর পেছনে অনেক বিষয় জড়িত। এটার স্থায়ী সমাধান করতে হলে শুধু প্রশাসনিক নয়, দরকার সমন্বিত উদ্যোগ।
পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে জেলা প্রশাসনেরও নেই তেমন কোনও পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতি বছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। স্থায়ী পূনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় লোক দেখানো এসব অভিযানের পরপরই পাহাড়ে আবার ফিরে যায় বসবাসকারীরা। আর বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে প্রশাসনের তোড়জোড় থাকলেও বর্ষার পরপরই বিষয়টি চোখের আড়ালে চলে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রচলিত আইনেই পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া আছে প্রশাসনকে। সরকারের স্বদিচ্ছা আর প্রশাসনের আন্তরিকতা থাকলে অধিগ্রহনের নামে অর্থের অপচয়ের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
প্রশাসনের হিসেবে চট্টগ্রামে ১৫ বছরে পাহাড় ধসে ৪ শাতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ২০০৭ সালে শুধু একদিনে মারা যায় ১২৭ জন। মুলত এরপর থেকেই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপুর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে নানামুখি পরিকল্পনা নেয় সরকার। কিন্তু সব পরিকল্পনায় থাকছে কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ।
পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা বলেন, ‘পাহাড় কাটা ও দখলের সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত হলেও কখনোই প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দখলকারীরা তাদের অবস্থানেই বহাল আছে। উল্টো প্রতিবছর নতুন পাহাড় কেটে আরও বসতি স্থাপন করছে। এভাবে চলতে থাকলে এক দশক পরে শহর ও আশেপাশের এলাকায় একটি পাহাড়ও আর অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আর পাহাড় রক্ষার দাবিও জানাতে হবে না। সব পাহাড় শেষ হওয়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মীরা বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত করা ও তাদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের সুপারিশগুলোই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দখল হওয়া পাহাড়গুলোর অধিকাংশের মালিক সরকারি সংস্থা। অথচ তাদেরই কোনও নড়চড় নেই।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২৪
আপনার মতামত জানানঃ