
প্রাচ্যের এক সময়ের সমৃদ্ধ সভ্যতা ইয়েমেন আজ মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এই ভয়াবহ সংখ্যার মধ্যেও হৃদয়বিদারক সত্য হলো, এর মধ্যে অন্তত ১০ লাখ শিশু রয়েছে যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার এক আবেগঘন ও সতর্কবার্তামূলক বিবৃতিতে জানান, ২০২৩ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া খাদ্য সংকট দিনে দিনে আরও তীব্র হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরে অনাহারী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখে পৌঁছাতে পারে, আর আগামী বছরে ক্ষুধার্ত শিশুদের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ১ কোটি ২০ লাখে। এর ফলে বহু শিশু দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হবে—যার ক্ষত হয়তো কখনও পূরণ হবে না।
এখন প্রশ্ন আসে—এই দুর্দশার পেছনে আসলে দায়ী কে বা কী?
টম ফ্লেচার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তার তহবিল আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। জাতিসংঘের কাছে ইয়েমেনের জন্য ২.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত এসেছে মাত্র ২২২ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রয়োজনের মাত্র ৯ শতাংশ। এমন অপ্রতুল সহায়তা এক ভয়ঙ্কর সংকেত—বিশ্ব হয়তো ধীরে ধীরে ইয়েমেনের মানবিক সংকটের প্রতি তার মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।
ইয়েমেনের এই বিপর্যয়ের শুরু ২০১৪ সালে, যখন ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে নেয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর থেকে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বিদ্রোহীদের পরাস্ত করতে ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও নারী। জাতিসংঘ বলছে, এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই বেসামরিক নাগরিক।
ইয়েমেন এখন এক ভয়ানক চক্রে আটকে পড়েছে—যেখানে অনাহার, সহিংসতা, দারিদ্র্য আর আন্তর্জাতিক উদাসীনতা পরস্পরকে শক্তি জুগিয়ে চলেছে।
সম্প্রতি, জাতিসংঘের ইয়েমেনবিষয়ক বিশেষ দূত হ্যান্স গ্রুন্ডবার্গ আরও উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়েছেন। লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীরা আবারও বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করেছে। সাত মাস বিরতির পর এই হামলা যুদ্ধের আগুনকে আবারও জ্বালিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। হুতিদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যতদিন গাজায় যুদ্ধ চলবে, ততদিন তারা এই হামলা বন্ধ করবে না। এর মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ইয়েমেন সংকট শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং তা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক জটিল ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো—এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ কোথায়?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ আর অনাহারের সমাপ্তি সম্ভব নয় শুধু সামরিক উপায়ে বা মানবিক সহায়তার খণ্ড খণ্ড চেষ্টায়। ইয়েমেনের জন্য প্রয়োজন এক বিস্তৃত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, যেখানে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থামিয়ে একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে, কারণ একটি জাতি ধ্বংসের মুখে পড়ে গেলে তার পুনর্গঠন শুধু টাকার মাধ্যমে সম্ভব নয়—তাতে লাগে সময়, সদিচ্ছা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
ইয়েমেনের এই করুণ অবস্থা আমাদের সামনে আবারও এক তিক্ত বাস্তবতা হাজির করে—যে বিশ্বে রাজনৈতিক ক্ষমতা, আঞ্চলিক আধিপত্য আর সামরিক শক্তির খেলায় সবচেয়ে বেশি মূল্য চুকাতে হয় সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে শিশুদের, যারা যুদ্ধ চায় না, রাজনীতি বোঝে না, কেবল একটু খাবার আর নিরাপত্তার আশায় প্রহর গুনে।
একটি সভ্য জাতিকে ধ্বংস করতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু তার পুনর্গঠনে লাগে কয়েক প্রজন্মের লড়াই। ইয়েমেন হয়তো টিকে থাকবে, কিন্তু সেই টিকে থাকার গল্প হবে ক্ষুধা, কান্না আর খণ্ডিত শৈশবের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এক দীর্ঘ, রক্তাক্ত ইতিহাস।
আপনার মতামত জানানঃ