সিলেটে সরকারি টিলা কেটে ২৫১ কোটি ৫২ লাখ টাকার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ইজারাদার মেসার্স বশির কোম্পানির মালিক মোহাম্মদ আলীর (৪০) বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক। বুধবার রাতে দুদক সিলেটের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
সূত্র মতে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ১৩৭ দশমিক ৫০ একর আয়তনের শাহ আরেফিন টিলার নিচে রয়েছে বিপুল পাথরে সম্পদ। এসব পাথর উত্তোলনে করতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে সরকারি খাস খতিয়ানের বিশাল এই টিলায়। লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এই টিলার পুরোটা খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য গর্ত। এতে অস্তিত্ব সংকটে খোদ টিলাই। টিলার মাটি কেটে গর্ত খুঁড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে প্রায়ই মাটি ধসে এখানে মৃত্যু হয় শ্রমিকের। গত পাঁচ বছরে এই টিলা ধসে মারা গেছেন অন্তত ২৫ জন পাথর শ্রমিক। অবৈধভাবে টিলা ধ্বংস করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। এরইপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে এই টিলা থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলাও হয় একাধিক। তবু ঠেকানো যায়নি অবৈধ পন্থায় পাথর উত্তোলন। এবার দুদকের পক্ষ থেকে আড়াইশ’ কোটি টাকার পাথর লুটের অভিযোগে মামলা করা হলো।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে ১০ শর্তে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত চিকাঢুরা মৌজায় শাহ আরেফিন টিলার ২৫ হেক্টর বা ৬১ একর এলাকা থেকে সাধারণ পাথর উত্তোলনের জন্য ২০০৫ সালের ৫ এপ্রিল এক বছরের জন্য মেসার্স বশির কোম্পানি পাথর কোয়ারি ইজারা পায়।
কিন্তু ইজারাদার মেসার্স বশির কোম্পানির মালিক মোহাম্মদ আলী শর্ত ভঙ্গ করে পাথর উত্তোলন করেন। এতে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাথর উত্তোলন অব্যাহত রাখেন ইজারাদার। পাথর উত্তোলনের জন্য ৬১ একর এলাকায় অনুমোদন পেলেও তিনি ১৩৭.৫০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত সম্পূর্ণ টিলা থেকে পাথর উত্তোলন করতে থাকেন। এক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালাও অনুসরণ করেননি ইজারাদার মোহাম্মদ আলী। অথচ পাথর উত্তোলনে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, শাহ আরেফিন টিলার ২৫ হেক্টর বা ৬১ একর পাথর উত্তোলনের জন্য ইজারা গ্রহণ করে ১৩৭.৫০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত সম্পূর্ণ টিলা থেকে ২৫১ কোটি ৫৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যের ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ ঘনফুট পাথর অবৈধ উপায়ে উত্তোলন করে সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন করেছেন আসামি মোহাম্মদ আলী। তাই তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০ ও ৪০৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০১৭ সালে শাহ আরেফিন টিলা থেকে পাথর উত্তোলনে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর এ টিলায় অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর প্রেক্ষিতে সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা হাকিম (এডিএম) আবু সাফায়াৎ মুহম্মদ শাহেদুল ইসলামকে প্রধান করে জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে।
তদন্তে ইজারাদারের অনিয়ম পাওয়া যায়। ৬৫ একর ভূমির ইজারা নিয়ে ১৩৭ একরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর কথা বলা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। টিলা ধ্বংসের সাথে জড়িত ৪৭ জনের নামও তখন ওঠে আসে।
টিলা কেটে পাথর উত্তোলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শাহ আরেফিন খানকা শরিফের খাদেম এবং ইজারাদার জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ সিলেট। এখানে আছে সবুজ পাহাড়ের গল্প, চা-বাগানের সারি সারি গাছ, স্বচ্ছ নীল প্রকৃতির ভূমি আর দেয়ালে পুরাকীর্তির ও সভ্যতার দীর্ঘ সব ইতিহাসের এক অফুরক্ত ভাণ্ডার। আধ্যাত্মিক রাজধানীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা এলে উঠে আসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজে ঘেরা অগনিত পাহাড়, টিলা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কালের বিবর্তন, কথিত নগরায়নের প্রয়োজন, প্রশাসনিক উদাসীনতা ও পাহাড় খেকোদের অশুভ পাঁয়তারায় শহর ও শহরতলীর পাহাড়গুলোতে এখন চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব। তাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল বলে খ্যাত নগরী সিলেটের পরিবেশ। শহরের প্রায় পাহাড়েই অবাধে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এলাকার প্রভাবশালী আর এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এক সময় সিলেট বৃক্ষের জঙ্গল হিসাবে পরিচিত ছিলো। টিলায় টিলায় সজ্জিত ছিল নগরী। সে টিলায় ছিল নানা গাছপালা আর লতাপাতার ঝোপ। এসব টিলা দেখে মনে হতো ‘সবুজের গালিচা’। কিন্তু কালের আবর্তনে এ জনপদে সে ঐতিহ্য আর নেই। বর্তমানে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি চলছে পাহাড় নিধনের প্রতিযোগিতা। ফলে মানুষের কঠিন হাতের ছোঁয়ায় সেই সবুজের সমাহার আজ ধ্বংসের মুখে।
আগে নগরে ঠিক কতটি টিলা ছিল, এখন কতগুলো টিকে আছে, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ১৯৫৬ সালে ভূমির মাঠ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, টিলাশ্রেণির ভূমির হিসাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি জেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলার সংখ্যা বের করেছে। এর মধ্যে নগরী ও উপকণ্ঠের এলাকা মিলিয়ে সিলেট সদর উপজেলায় টিলা রয়েছে ১৯৯টি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের নভেম্বরে সিলেটে সব ধরনের পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। এছাড়া পরিবেশ আইনেও পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদিও আইন-আদালতের এসব বিধি-নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছে না পাহাড়খেকোরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরী ও এর আশপাশসহ জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় এখনো টিকে থাকা ৩৫১টি টিলার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই রয়েছে ঝুঁকিতে। এসব টিলা কাটতে তৎপর রয়েছে একটি গোষ্ঠী।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, পাহাড়-টিলা কাটার বিরুদ্ধে প্রতি মাসেই কিছু না কিছু অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়। অভিযানের পর কিছুদিন এই অপতত্পরতা বন্ধ থাকলেও পরে আবার যেই কে সেই। পাহাড় কর্তনকারীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে আবাসনের প্রয়োজনে টিলা সাবাড় হচ্ছে, সেই নিরাপদ আবাসভূমির জন্য টিলার সুরক্ষা দরকার। কেননা ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেট নগরীর জন্য টিলা হচ্ছে প্রাকৃতিক ঢাল।
তারা বলেন, অভিলম্বে পাহাড় কাটা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেই সঙ্গে অবাধে পাহাড় ও বন কাটা বন্ধ করে দেশীয় প্রজাতি ফল-মূলসহ নানা বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে এবং বনায়ন করে হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৭৩৮
আপনার মতামত জানানঃ