দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। অঞ্চলটি ২০২১ সালে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি)।
শুক্রবার ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে এশিয়ার অর্থনীতি বিষয়ক সম্পূরক আউটলুক প্রকাশ করেছে এডিবি। এতে এশীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আগের দেয়া পূর্বাভাস সংশোধন করা হয়েছে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক সাপ্লিমেন্ট জুলাই ২০২১ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়ে কমবে। সব মিলিয়ে উন্নয়নশীল এশিয়ার জিডিপি গড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে এ বছর। আগামী ২০২২ সালে এটি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
এ বছর চীনের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৮ দশমিক ১ শতাংশ যা ২০২২ সালে সাড়ে ৫ ভাগে নেমে আসবে। এ বছর ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১০ শতাংশ যা পরের বছর সাড়ে ৭ ভাগে নেমে আসতে পারে।
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এপ্রিলের পূর্বাভাস ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে দেশগুলোতে অর্থনীতির গতি শক্তিশালী হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই নিম্নগতির অন্যতম কারণ ধরা হচ্ছে ভারতের পরিস্থিতিকে। গত এপ্রিলের পূর্বাভাসে এডিবি বলেছিল, ২০২১ সালে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ হতে পারে। এখন বলা হচ্ছে, এর হার হবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। আর ২০২২ সালে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে সাত শতাংশ।
তবে দুই দফায় লকডাউনে ভুটানের অর্থনীতি এ বছর ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সংকোচনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে এই লকডাউনের প্রভাবে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তবে অর্থনীতির গতি কমে গেছে। মালদ্বীপে এ বছরের প্রথম দিকে পর্যটন আগমন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে দেশটিতে গত মার্চে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বহু দ্বীপ লকডাউন করতে হয়েছে। এতে মালদ্বীপের অর্থনীতির গতিও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপালে ২ দশমিক ১ শতাংশের সংকোচনের ধারণা করা হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলের আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে ছিল। কিন্তু দেশটির নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হওয়ায় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াও থমকে যাচ্ছে। ২০২০ সালে দেশটির অর্থনীতি ১ দশমিক ৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল।
অন্যদিকে, ২০২১ সালে পূর্ব এশিয়ার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে এডিবি। এর পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে চীনা অর্থনীতির। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ইতিবাচক গতি অব্যাহত থাকায় ২০২১ সালে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এডিবির প্রতিবেদেনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৪ দশমিক ৪ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। মধ্য এশিয়ার পূর্বাভাস ৩ দশমিক ৪ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে এশিয়ার মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এপ্রিলের পূর্বাভাসে ২ দশমিক ৩ শতাংশ মূলস্ফীতির হার ধারণা করা হলেও এবারের প্রতিবেদনে এই হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ করা হয়েছে। তবে আগামী বছর মূল্যস্ফীতির হার ২ দশমিক ৭ শতাংশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এডিবি উল্লেখ করেছে, করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে বেশ ভালোই এগুচ্ছিল এশিয়ার অর্থনীতি। কিন্তু নতুন করে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ উদ্বেগ বাড়িয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে করোনার আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৪ হাজারে ছাড়িয়ে যায়। মে মাসের মাঝামাঝি দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ১ লাখ ৯ হাজারের মতো। প্রতি ১০ লাখে ২৬ জন শনাক্ত হচ্ছে এশিয়া অঞ্চলে। তবে বিশ্বে সংক্রমণের গড় হার (প্রতি ১০ লাখে ৪৯) এর তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
করোনার এই ধাক্কা তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। প্যাসিফিক অঞ্চলে পাপুয়া নিউগিনি এবং ফিজিতেও আঘাত হেনেছে। তবে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে করোনার সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বহু দেশে ভ্যাক্সিন কার্যক্রম এগিয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল এশিয়ার দেশগুলোতে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরিতে পিছিয়ে রয়েছে। জুন পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জনে ৪১ দশমিক ৬ ডোজ টিকা নিশ্চিত করতে পেরেছে যা বৈশ্বিক গড় ৩৯ দশমিক ২ থেকে কিছুটা বেশি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ) ইউরোপীয় ইউনিয়ন (৮১ দশমিক ৮ শতাংশ) থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়েছে, বিদায়ি ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসের তথ্যে দেখা যায় রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ১০ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থবছরের ১০ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে। তবে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে এপ্রিলের শুরু থেকে দেশে চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ফের বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় দেশের অর্থনীতির গতি ধীর করে দিচ্ছে।
এবিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পুরোদমেই চলছিল। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমদানি বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি আগের চেয়ে বেড়েছিল। কিন্তু গত এপ্রিল মাস থেকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যাত্রাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। অর্থনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টিকবে নাকি আবার খাদের মধ্যে পড়বে, তা নির্ভর করবে আমরা করোনা সংকটকে কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে মোকাবিলা করছি।
তারা বলেন, যত দিন করোনার টিকা পুরোপুরি দেওয়া না হবে, তত দিন অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে প্রাণ নেই। সরকার নিজেই বলছে, ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে আরও এক বছর লাগবে। এর মানে, এক বছরের আগে অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হওয়ার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বেশ চাঙা এবং ইউরোপের অর্থনীতি সচল হতে শুরু করেছে। তবে বিশ্ব এখন দুই ভাবে বিভক্ত। এক পাশে আছে টিকা কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন এমন দেশগুলো। অন্য পাশে টিকা দেওয়া হয়নি বা কম দেওয়া হয়েছে এমন দেশগুলো। বাংলাদেশ এখনো দ্বিতীয় কাতারের দেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে টিকা দেওয়া হয়েছে এমন দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে পারে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার আগের জায়গায় ফিরবে, তা বলা কঠিন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৮
আপনার মতামত জানানঃ