মোহাম্মদ রুবেল
প্রতিনিয়ত জোনাকি বেগমের বয়ান শ্রবণ আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই – সূর্য হতে ধার করা আলোয় চলতে হয়, তেমনি জোনাকি বেগমের আলোয় আমি উদ্ভাসিত হই। ফজরের নামাজ শেষ পূর্বক জোনাকি বেগমের বয়ানে ওঠে আসে আদি হতে অন্ত পর্যন্ত বহুকিছু।আলেমকূলের শেষ ভরসা যেমন ইবনে কাসীরের ‘আল- বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ কিতাব খানা তেমনি আমারো একমাত্র অবলম্বন জোনাকি বেগমের ফজরের পর প্রদত্ত বয়ান সমূহ।
তাপসী জোনাকি বেগমের আজকের প্রশ্ন ছিল, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনকে কেন ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হতে হয়েছিল? আমি অনায়াসে বলে দিলাম মনিকার সাথে যৌন কেলেঙ্কারির জন্য। জোনাকি বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন তোমরা মিয়ারা কাগজের সার্টিফিকেট পেয়েছো সত্য, কিন্তু পড়াশোনা জানো না মোটেও। তিনি বললেন, ক্লিনটন সাহেব সেক্স করার জন্য ইমপিচের মুখোমুখি হননি, তিনি ইমপিচের মুখোমুখি হয়েছিলেন মিথ্যা বলার জন্য। অর্থাৎ, পশ্চিমে সত্য হলো আইনের প্রধানতম নিয়ামক। তিনি তারপর বললেন, তোমাদের অবস্থা হলো ভেড়ার পালের মতো, সামনেরটা যেদিকে যায় বাকীগুলো সেদিকেই যায়। কেউ একজন ক্লাসে – টকশোতে – ওয়াজে কিছু একটা বলে দেয় আর তোমরা চিন্তা ভাবনা বা যাচাই-বাছাই না করেই তা গিলতে থাকো। যেহেতু আমার দরগাহের বায়াত নিয়েছো সেহেতু না জেনে বিনা গবেষণায় আজ হতে কিছু বলবানা। আমি টেলিফোনের অপর প্রান্ত হতে জবাব দিলাম- আজ্ঞে হযরত।
জোনাকি বেগম বললেন তুমি তো বাংলাদেশ ও ইয়োরোপ দেখেছো। এই দুই জায়গার পুলিশ সম্বন্ধে তোমার মতামত বলো। আমি তোতা পাখির মতো বলে দিলাম, বাংলাদেশের পুলিশ ঘুষ খায়, ইয়োরোপের পুলিশ ঘুষ খায়না। জোনাকি বেগম বললেন, চায়ের কাপে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে নাস্তা করে শৈশব পার করা লোক তোমরা। হলের ডালের পানি আর ছারপোকার কামড় খেয়ে, নীলক্ষেতের সস্তা নোট পড়ে পাশ করা লোকদের পাণ্ডিত্য এমন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে শোন মিয়া, ইয়োরোপে সবাই আইন মানে তাই তুমিও সেখানে আইন মানো। একই ব্যক্তি তুমি যখন বাংলাদেশে আসো তখন তুমি আইন মানোনা কারণ এখানে কেউ আইনের তোয়াক্কা করেনা। ইয়োরোপের পুলিশ কাজ করে মাত্র পাঁচ শতাংশ লোকজনকে নিয়ে কারণ ঐ পাঁচ শতাংশ লোকজনের মাঝে আইন না মানার প্রবণতা রয়েছে। তেমনি বাংলাদেশে আইন মানে মাত্র পাঁচ শতাংশ লোকজন, আর বাকীরা আইন কি, সেটাই বুঝতে চেষ্টা করে না। যে দেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে আইন বুঝে না, মানাতো দূরের কথা – সে দেশের পুলিশ ঘুষ খায় শুধু এই বলে নিজে সাধু হওয়া যাবে না। পুলিশ তো এ সমাজেই বেড়ে ওঠা মানুষ, হঠাৎ করে তার কাছে সাধুতা প্রত্যাশা করা অজ্ঞতা নয় কি? আমি বললাম, জি মুহাদ্দিস সাহেবান।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠীর নিয়ে আমার মতামত জানতে চাইলে আমি বললাম, আমি তো ডালের পানি খেয়ে পাশ করা লোক। আপনিই বলুন- হে মোহতারিমা। তিনি হেসে বললেন, তোমাকে স্নেহ করি যদিও তুমি বয়সে আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়। তবে যেদিন তুমি দর্শন – লজিক আর বিজ্ঞানধর্মী মননের অধিকারী হবে সেদিন আমার অন্দর মহলে তুমিও নিমন্ত্রিত হবে। তিনি বললেন, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিরা লেখে এবং কথা বলে তাদের খদ্দেরদের চাহিদা মাফিক। তিনি আরো বললেন, তোমরা মিয়ারা ইয়োরোপে বসে বাংলাদেশে শরিয়া চাও। এখন আমি যদি বলি ইয়োরোপেও খ্রিস্টান শরিয়া হোক – তখন তুমি বলো এগুলো মানবাধিকারের দেশ, এখানে এগুলো হওয়া উচিত নয়। তোমাদের চারিত্রিক এই মোনাফেকি তো বুদ্ধিজীবিদের দু’মুখো নীতির ফসল। বাংলার বুদ্ধিজীবিরা এমন তর্কবাগীশে উন্নীত হয়েছে যে, এক কথায় বলা যায় আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আসার মতোই।
কবি ইকবাল তার ‘শিখওয়াতে’ আল্লাহর প্রতি অভিযোগ এনে লিখেছিলেন, হে আল্লাহ, আপনি ইয়োরোপ ও আমেরিকাকে প্রভুত জ্ঞান দিয়ে জগতের ঈশ্বর বানিয়েছেন, আর মুসলমানদের সামনে হুরের কলা ঝুলিয়ে ছাগল বানিয়ে রাখলেন। এটা লেখার পারে মুসলমানরা তার পিঠের চামড়া আর গর্দান কাটার জন্য হুমকি দিলে তিনি ‘জবাবে শিখওয়া’ লিখে রাতারাতি মুসলমানদের প্রভূত সম্মানের অধিকারী হয়ে কবি ইকবাল হতে আল্লামা ইকবাল হয়ে গেলেন।
এরপর তিনি বললেন, শোন বাবু- ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মন হলো ছোট পাতিলের মতো। অল্প আগুনে গরম হয়ে যায়। কবি ইকবাল তার ‘শিখওয়াতে’ আল্লাহর প্রতি অভিযোগ এনে লিখেছিলেন, হে আল্লাহ, আপনি ইয়োরোপ ও আমেরিকাকে প্রভুত জ্ঞান দিয়ে জগতের ঈশ্বর বানিয়েছেন, আর মুসলমানদের সামনে হুরের কলা ঝুলিয়ে ছাগল বানিয়ে রাখলেন। এটা লেখার পারে মুসলমানরা তার পিঠের চামড়া আর গর্দান কাটার জন্য হুমকি দিলে তিনি ‘জবাবে শিখওয়া’ লিখে রাতারাতি মুসলমানদের প্রভূত সম্মানের অধিকারী হয়ে কবি ইকবাল হতে আল্লামা ইকবাল হয়ে গেলেন। ‘রঙ্গিলা রাসূল’ বইয়ের প্রকাশক রাজপালের হত্যাকারী ইলমুদ্দিনের জানাযার নামাজ পড়ানো জন্য আল্লামা ইকবালকে ইলমুদ্দিনের পিতা অনুরোধ করলে ইকবাল সাহেব সুকৌশলে কেটে পড়লেও বোকা মুসলমানরা বুঝতে পারেনি। বুঝবে কি করে? এরা আল কিন্দি, ইবনে সিনা, আল রাজি, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন বাদ দিয়ে প্যারা ডক্সিক্যাল সাজিদ পড়া মোল্লাতন্ত্রের আলেমে দ্বীন। আসলে এখানে সবাই আইনের ব্যাখা করে নিজের সুবিধা মাফিক।
জোনাকি বেগম বললেন, তাহলে একটা গল্প শোন। বাংলাদেশে কোন এক পীরের মৃত্যুবার্ষিকীতে বার্বুচিদের অসতর্কবস্থায় রান্না করা গরুর মাংসের ডেকে একটি কুকুর মাংস খেতে লাগলো। সকলে হায় হায় করে ওঠলো কারণ কুকুরে মতো নাপাক প্রানীর মুখ লাগলে সেই খাওয়া মুসলমানদের জন্য হারাম। তখন অবস্থা বেগতিক দেখা দরগাহের চতুর প্রধান খাদেম মাইক হাতে নিয়ে গজল গাইতে লাগলেন জনতার উদ্দেশ্যে। গজলের কথা গুলো হলো—- “বাবা সূরত পাল্টাইছে, বাবা তায়া পাল্টাইছে, কুত্তার ছবি ধইরা বাবা গোস্ত খাইয়াছে”। ব্যাস আর যায় কোথায়! উপস্থিত জনতা মাংসকে তবারক মনে করে পেটপুরে খেয়ে বাসায়ও কিছু মাংস নিয়ে গেলো অসুস্থ বাবা মায়ের জন্য এবং গর্ভবতী বৌয়ের জন্য। জোনাকি বেগমে কথার বানে আমার সময়ের সংকট দেখা দিলো। তিনি কবি আল্লামা ইকবাল সাহেবের একটি কবিতার দুটো লাইনের বাংলা তরজমা শুনিয়ে কলটা কেটে দিলেন। লাইন গুলো হলো….”হকের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? তোমার ঈমান হলো পয়সা। সত্য বলতে এটি হলো ফিতনা। কুফর তো এমনই হয়।”
লেখক : মোহাম্মদ রুবেল, ভিয়েনা।
আপনার মতামত জানানঃ